শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ অপরাহ্ন

শাসক জাহাঙ্গীর

সুদেব রায়:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ আগস্ট বুধবার দ্বিপ্রহরে অম্বর-মহিষী মারিয়াম উজ-যামানীর কোল আলো করে মোগল সম্রাট আকবরের যে পুত্রের জন্ম হয়েছিল তিনি ছিলেন দোষে-গুণে ভরা এক বর্ণময় চরিত্র। রূপকথার মতোই ছিল যুবরাজ সেলিমের জন্মবৃত্তান্ত। আগ্রা থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে এক ৯০ বছরের ফকিরের কাছে মোগল সম্রাট আকবর প্রায় ধরনা দিয়েছিলেন পুত্রসন্তানের কামনায়, কেননা ১৫৬৪ সালে তার যমজ পুত্র হলেও এক মাসের মধ্যেই তারা মারা যায়। তাই আকবরের সন্তান হওয়ার পর সম্রাটের বিশ্বাস হয়েছিল এ বৃদ্ধ ফকিরের আশীর্বাদেই তার পুত্রসন্তান জন্মেছে, তাই তিনি তার নাম রাখলেন ফকিরের নামানুসারে সেলিম। আসলে সে বৃদ্ধ ফকিরের নাম ছিল সেলিম চিশতি। আকবর তার শিশুসন্তানকে আদর করে ‘শেখু বাবা’ বলে ডাকতেন। তার পুত্র সেলিমের যেখানে জন্ম হয়েছিল, সেই গ্রামে তিনি একটি নতুন নগরী স্থাপন করলেন, যার নাম দেয়া হলো ফতেহপুর সিক্রি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেলিমের প্রথম বিবাহ দিয়েছিলেন আকবর। পাত্রী ছিলেন রাজপুতানী কন্যা মানবাঈ, যার পিতা ছিলেন অম্বাধিপতি ভগবানদাস। হিন্দু ও মুসলিম দুই রীতিতেই এ বিবাহ হয়েছিল। বলা বহুল্য, সেলিমের প্রথম এ স্ত্রীর সন্তান ছিলেন খুসরো। সেলিমের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন মানমতী, ইতিহাসে যিনি যোধাবাঈ নামে খ্যাত। খুররমের জননী হিসেবে যোধাবাঈ ইতিহাসে স্মরণীয়, যে খুররম ইতিহাসে পরিচিত শাহজাহান নামে। জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’তে লিখেছেন, ‘তার জন্মে পৃথিবী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সে আমার অন্য সব ছেলেমেয়ের চেয়ে আমার পিতার দিকে বেশি দৃষ্টি দিত। আমার পিতাও তার ব্যবহারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। আমাকে তার গুণের কথা শুনিয়ে বলতেন যে তার সঙ্গে আমাদের অন্য কোনো ছেলেমেয়ের তুলনাই হয় না। সেই ছিল তার প্রকৃত নাতি।’ যে পুত্ররা কোনো এক সময় সেলিমের গর্ব ও অহংকার ছিল তাদের অসন্তোষ ও বিদ্রোহ সম্রাটকে যারপরনাই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল।
৩৬ বছর বয়সে জাহাঙ্গীর যখন ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন, তখন মোগল শাসন তার পিতা আকবরের কল্যাণে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে। তিনি ছিলেন লম্বা, ফর্সা, তীক্ষ চোখযুক্ত একজন পুরুষ। তার প্রশস্ত বুক ও সুগঠিত বাহু দৃঢ়চেতা এবং ক্ষিপ্র মানসিকতার পরিচয় দিত। পাশাপাশি সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারার ক্ষমতা, নম্র আচরণ, উদার মানসিকতা, জ্ঞানদীপ্ত উৎসাহ বোধ অতি সহজেই রাজকর্মচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পোশাকের ব্যাপারে উন্নত রুচিবোধ, খাদ্যের ব্যাপারে স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি সংগীত সাহিত্য এবং চিত্রশিল্প বিষয়ে অগাধ পা-িত্যবোধ তাকে আগের তিনজন মোগল সম্রাটের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল। তার সময়ে মোগল চিত্রকলা অনতিক্রম্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের গুণমুগ্ধ পৃষ্ঠপোষক। পৃথিবীর প্রথম ংবধসষবংং পবষবংঃরধষ মষড়নব তার রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি নারী, আফিম ও মদ্যপানের প্রতি আসক্তি অনেকটাই তার রাজ্য শাসনের কাজে বিঘœ ঘটিয়েছিল এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খুসরোর বিদ্রোহ পরবর্তী ক্ষেত্রে তাকে অনেকাংশে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল।
আকবর যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন আকবরের বিশেষ স্নেহভাজন জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র খুসরো মীর্জা পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খুসরোর মামা রাজা মানসিংহ, শ্বশুর খান-ই-আজম আজিজ কোকা প্রমুখের পরামর্শে যুবরাজ সেলিমের পরিবর্তে খুসরোকে সিংহাসনে বসানোর চক্রান্ত হয়। পিতামহ আকবরের স্নেহভাজন খুসরো আশা করেছিলেন আকবর তাকেই উত্তাধিকারী মনোনীত করবেন। কিন্তু তা পূরণ না হওয়ায় তিনি পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন (১৬০৫)। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যে অপরাধে তিনি পিতার হাতে একটি চড় খেয়েছিলেন এবং ১০ দিনের জন্য সংযত জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছিলেন, ঠিক সেই অপরাধে তিনি পুত্রকে অন্ধ করে দেন মর্মান্তিক যন্ত্রণা দেয়ার পর। তবে যে নৃশংস পদ্ধতিতে তিনি হত্যা করেছিলেন তাতে তাকে ‘স্যাডিস্ট’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুনকে মৃত্যুদ- দেন জাহাঙ্গীর, যার অপরাধ ছিল তিনি খুসরোকে আশ্রয় দেন। গুরু অর্জুনকে প্রথমে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও পরে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এছাড়া সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে বীর সিং বুন্দেলা আবুল ফজলকে হত্যা করলে বীর সিং বুন্দেলাকে তিন হাজার মনসবদার পদ দেয়া হয়।
১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসীন হয়েই সেলিম ‘নূরউদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী’ উপাধি নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ‘জাহাঙ্গীর’ শব্দের অর্থ হলো ‘জগতের মালিক’। জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসার পর ১২টি উদার আইন জারি করেন। এগুলো ‘দস্তুর উল-আমল’ নামে পরিচিত। এগুলো ছিল (১) তামাঘা (বিশেষ বাণিজ্য শুল্ক), মীর বাহরী (নদীপথে বাহিত পণ্য শুল্ক) প্রভৃতি অতিরিক্ত কর রদ করা (২) মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি উত্তরাধিকারীকে দান করা এবং উত্তরাধিকারী না থাকলে রাষ্ট্রের হস্তগত করা। (৩) মদ ও অন্যান্য নেশার দ্রব্য ক্রয় ও বিক্রয় বন্ধ করা। (৪) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেদ করে অপরাধীকে শাস্তি না দেয়া। (৫) বছরের কয়েকটি বিশেষ দিনে এবং প্রতি বৃহস্পতিবার পশুবধ নিষিদ্ধ করা প্রভৃতি। এছাড়া তিনি তামাঘা ও মীর বাহরী নামে নদীকর নিষিদ্ধ করেন। তার সময়ে সরাইখানা নির্মাণ করা হয় এবং শাস্তিদান হিসেবে নাক কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জাহাঙ্গীর রবি ও বৃহস্পতিবার পশুহত্যা নিষিদ্ধ করেন। কারণ রোববার ছিল আকবারের জন্মদিন ও বৃহস্পতিবার ছিল জাহাঙ্গীরের অভিষেক। আগেই উল্লেখ্য, পিতৃসূত্রে জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য পেয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর এ পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারণ করেছিলেন। এদিক থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অবাহিত কাবুল রক্ষার জন্য কান্দাহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এর মধ্যে জলের অভাব ছিল না। কাবুল ও হেরাতের পথের সংযোগ স্থলে দুর্গটি দক্ষিণ আফগানিস্তানের ওপরে আধিপত্য রেখেছিল। বালুচ ও আফগানিস্তানের উপজাতিদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে গেলে কান্দাহারের ওপর আধিপত্য স্থাপন ছিল অনিবার্য। এ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর ঠট্টার শাসক জানি বেগের ছেলে মীর্জা গাজি বেগকে বৃহৎ সেনাদল দিয়ে কান্দাহারে পাঠান। এ সময় শাহ আব্বাস তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় এদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারেননি। সুতরাং আক্রমণকারী সৈন্যদলের কাছে তাড়াতাড়ি কান্দাহার দখল করার মতো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এ সময় কান্দাহারের শাসক ছিলেন শাহ বেগ খান। যিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, অনুগত ও দক্ষ সেনাপতি। তিনি কান্দাহার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়িয়ে ভেতরের সৈন্যদলকে ভালোভাবে রেখেছিলেন, ফলে গাজি বেগ যখন কান্দাহারের কাছাকাছি, তখনো অবরোধ চলছিল। পারসিকরা ভাবতে পারেননি মোগলরা এত তাড়াতাড়ি সীমান্তে পৌঁছে যাবে। দুদিকে যুদ্ধ করার অবস্থা না থাকায় তারা অবরোধ তুলে তাড়াতাড়ি সীমান্তের দিকে চলে যায়। শাহ আব্বাস এ সময় দৌত্যের মাধ্যমে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করলেও জাহাঙ্গীর তা প্রত্যাহার করেন। পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যে সীমান্ত নীতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ৪৫ দিন অবরোধের পর শাহ আব্বাস ১৬২২ সালে কান্দাহার দখল করেন। জাহাঙ্গীর সৈন্য সংগ্রহের দীর্ঘসূত্রতা এবং শাহজাহানের বিদ্রোহের কারণে ব্যর্থ হন কান্দাহার পুনর্দখল করতে।
জাহাঙ্গীরের জীবনের আর একটি সামরিক কৃতিত্ব ছিল কাংড়া দুর্গ জয়ের কাহিনী। এর আগে কোনো মুসলিম সুলতান কাংড়া দুর্গ জয় করতে পারেননি। আশপাশের পাহাড়ে ঘেরা কাংড়া দুর্গ ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। ১৬১৫ সালে জাহাঙ্গীর পাঞ্জাবের শাসক মুর্তাজা খানকে আদেশ দেন দুর্গটি দখল করার জন্য। কিন্তু তারা এ অভিযানে ব্যর্থ হলে ‘রাজা বিক্রমাদিত্য বাঘেলা’ নামে পরিচিত সুন্দর দাসকে কাংড়া অভিযানে পাঠান। ১৬২০ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে রাজা দুর্গটি অবরোধ করেন। এক মাস পরে দুর্গে খাদ্যাভাব দেখা দিলে সৈন্যরা ১৬২০ সালের ১৬ নভেম্বর দুর্গ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এছাড়া জাহাঙ্গীরের সময়ে মোগল বাহিনী বিহার, কামরূপ ও কাশ্মীরের কিশতওয়ার রাজ্য জয় করে। জাহাঙ্গীর তার সময়ে দো-আসপা ও সি-আসপা মনসবদারির প্রবর্তন ঘটান।
মনে করা হয় জাহাঙ্গীরের শাসনের শেষের সাত বছর (১৬২০-২৭ খ্রি.) তার স্ত্রী নূর জাহান নিজের হাতে ক্ষমতা রাখার প্রয়াস চালিয়ে যান। যদিও ড. বেণীপ্রসাদ এর দ্বারা নূর জাহানচক্র তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। এ কথা ঠিক যে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেন। মেবার, বাংলা ও দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমিত হয়। এ সময় জাহাঙ্গীরের শারীরিক অসুস্থতার কারণে নূর জাহান শাসন পরিচালনা করতেন। যদিও জাহাঙ্গীর সার্বভৌম ক্ষমতাশীল ছিলেন বলে মনে করা হয়।
জাহাঙ্গীরের সময় দুটি বিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তি হলো সাদা মার্বেল দ্বারা নির্মিত ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি এবং অন্যটি সেকান্দ্রায় আকবরের সমাধির কাজ শেষ করা। জাহাঙ্গীরের রাজসভায় বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন মনসুর, যিনি পশুপাখির চিত্র এঁকেছেন। সম্রাট তাকে নাসির-উস্-আসার উপাধি দেন। জাহাঙ্গীরের সময়কালে ১৬০৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে ক্যাপ্টেন হকিংস সুরাটে পৌঁছান, জাহাঙ্গীর তাকে ‘ইংলিশ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে হিন্দু উৎসব রাখি ও দশেরা পালিত হতো। জগন্নাথ ও জনার্দন ভট্ট ছিলেন তার সময়কার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ। তার শাসনামলে হিন্দুরা উচ্চ মনসবদার পদ পেত, উদাহরণ হিসেবে বলা হয় ৪৭ জন উচ্চ মনসবদারের মধ্যে ছয়জন ছিলেন হিন্দু। জাহাঙ্গীর ছিলেন চতুর্থ মোগল সম্রাট। তিনি তার আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যুতে তার রাজকীয় আদর্শ তুলে ধরেছেন। সুদেব রায়: শিক্ষক ও লেখক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com