কবি আল মাহমুদ বাংলা কবিতার বরপুত্র। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্য দিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলে তার কবিতার লাঙ্গল। শব্দের চাষবাসে মানুষ ও জীবনের ফসল। তার কবিতা-ফুলে নেচে ওঠে সময়ের প্রজাপতি। সে ফুলের সুবাসে মোহিত হয় পৃথিবী। চলমান সময়ের পাশাপাশি প্রেম, প্রকৃতি ও নারীর সফলায়তন চিত্রায়ন ফুটে উঠেছে কবি আল মাহমুদের কবিতার বায়োস্কপে। সেখানে চোখ রাখলে বিমোহিত চোখে পাঠক দেখতে পান যাপিত জীবনের উপাখ্যান। প্রথাগত ছন্দের শক্ত গাঁথুনিতে যেমন সময়ের উচ্চারণ, তেমনি মুক্ত ছন্দের সফল উপস্থাপনাও তার কবিতাকে করেছে ঋজুপাঠ্য। তার কবিতার পরতে পরতে প্রকৃতি, পরিবেশ, ঐতিহ্য ও মানুষের উপস্থিতি তৈরি করেছে চমৎকার এক দ্যোতনা।
পরাজিত হয় না কবিরা এই স্লোগানে যুদ্ধের সুর। জীবনের জয়-পরাজয়ে কবিতাই সঙ্গী । আল মাহমুদ এর বাগানে কবিতা যেমন ফুল হয়ে ফোটে, তেমনি অন্যায় অবিচারে তার কবিতা হয়ে ওঠে চকচকে সময়ের তরবরি। ঝনঝন করে বেজে উঠে সত্যের মিছিলে। মিথ্যার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় অপরাজিত খড়গ। কিন্তু সময়ের কাছে কবিকে কখনো কখনো নীরব হতে হয়। নির্মম যুগের সুঁই সূতোয় সেলাই করে বাঁধা হয় কবির মুখ। আর তখনই কবির কলমে লেখা হয় ‘সেলাই করা মুখ’। কলমের সে আঁচড়ে মিশে থাকে যাপিত জীবনের প্রেম বিরহ আর প্রতিবাদের পয়ার। সে পয়ারের সফল বুননে আঁকা হয় জীবনের চিত্রকল্প। শব্দের রং-তুলিতে কবি আঁকেন সময়ের দৃশ্যপট।
কবির মর্ম রহস্য ভেদ করা বড়ই কঠিন। কবিতার পয়ারে পয়ারে কবি-কল্পনার বুনোন থাকে, শব্দের কারিকুরি থাকে, স্বাধীনচেতা মনন থাকে। কিন্তু কবির সে স্বাধীনতা কখনো হৃত হয়। মুসলিম ইতিহাসের নবী ইউসুফের ঘটনা-সূত্র তুলে ধরে আক্ষেপ করে কবি লিখেছেন
তুমি কুয়ায় ফেলে দেয়া ইউসুফ
তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে বেচাকেনা হাটের সওদাগররা,
তুমি দাসানুদাস মাত্র। [সেলাই করা মুখ]
তবে হ্যাঁ, কবিদের অসাধারণ যোগ্যতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন কবি। ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগে একটা কথা খুব জোরে শোরে উচ্চারিত হত। ‘পোয়েটস আর দি প্রোফেট’- কবিরাই ভবিষ্যৎ বক্তা। তারা নির্ভয়ে বলতে পারে সব। ঠিক তারই প্রতিধ্বনি কবি আল মাহমুদের কবিতায়
তুমি কেন এত ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে পারো?
যে বছর এখনো আসেনি সে বছরের আকালের খবর
তুমি দিতে গেলে কেন?
তুমি কেন বলো না- আমি জানি না
তোমার মুখ থেকে কেন
জানি জানি জানি শব্দ বের হয়ে আসে। [সেলাই করা মুখ]
কবির মতে ভালবাসার কথা সবাই বলে। কিন্তু ভালবাসায় টিকে থাকে না কেউ। তবে বিরহের স্মৃতির মাঝে যেন এক প্রকার শান্তি খুঁজে পান কবি। গোলাপের কাঁটায় আবদ্ধ গোলাপের ভেতর যেমন সুবাস সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, তেমনি বিরহের ব্যথা বেদনার মাঝেও যেন একাকার হয়ে থাকে কিছু সুখের স্মৃতি। তাই তো কবির আক্ষেপ ভরা মিশ্র প্রতিক্রিয়াÑ
খেলছি খেলা কলম ধরে মলম লাগাই ক্ষতে
সবাই বলে ভালোবাসি, থাকে না স¦-মতে
প্রেমের তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে গেল সবই
কেউ ডেকেছে শত্রু বলে, কেউ ভেবেছে কবি।
থাকুক পড়ে ঘরের স্মৃতি, ভীতির মতো মুখ,
গোলাপ যেমন কাঁটার মধ্যে সৌরভে উন্মুখ। [চতুর্দশপদী]
নারীর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছেন কবি। নারীকে তুলনা করেছেন কাজ করা জামদানির সাথে। জামদানির ভাঁজ উল্টালে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্যে যেমন আপ্লুত হয় চোখ, তেমনি অঙ্গ সৌষ্ঠবে যেন পলে পলে সৌন্দর্য সাজিয়ে নারীকে সৃষ্টি করেছেন বিধাতা। তাই তো। আপ্লুত কবির কলমে লেখা হয়Ñ
নারী হলো একটা ভাঁজ করা জামদানি।
আমি আড়চোখে দেখি এর গোপন চুমকির কাজ।
কিছু নারী আছে শুধু ভালবাসতেই জন্মায়
যেমন সন্ধ্যামালতী, সাঁঝের সেঁজুতি জ¦লার সাথে সাথেই
অবসন্ন সৌন্দর্যের ভেতর সুন্দর হয়ে মরে যায়। [ভাঁজ]
এ অভিব্যক্তি যেন কেবল কবির একার নয়। জন্ম-মৃত্যু আর প্রেম-ভালবাসার এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে মৃত্যুই শেষ পরিণতি। তারপরেও প্রতিটি মানুষষের জীবনেই নারীর অবদান থাকে, যৌবনকালের স্মৃতি থাকে। নারীকে কেন্দ্র গড়ে ওঠে বিশাল সেই স্মৃতির মিনারের পদতলেই বারবার ফিরে আসে মানুষ।
সৃজন রীতির পৃষ্ঠায় লেখে কবি
জন্ম মৃত্যু প্রেম ভালবাসা সবই
এড়াতে পারে না ভাগ্যের মহামারি
প্রতি পৃষ্ঠায় ফিরে আসে সেই নারী
যার নৌকায় উঠেছিল যৌবনে
মনের ভেতর লুকিয়ে সংগোপনে। [হাতছানি]
তবে একথাও ঠিক যে প্রকৃতিকে যেমন তার কবিতার নানান অনুষঙ্গে নিয়ে এসেছেন কবি, তেমনি নারীকেও নিয়ে সাজিয়ছেন উপমা উৎপ্রেক্ষার বয়ান।
বসন্ত প্রকৃতির সেরা ঋতু। সে ঋতুর ব্যাপক প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনে। কবি আল মাহমুদ তার পারঙ্গম শক্তিতে একাকার করেছেন ঋতুরাজ বসন্তের সাথে তার প্রিয়তমার উৎপ্রেক্ষা। তবে এর ফাঁকে দেশের করুণ অবস্থার ইঙ্গিতও বর্তমান:
উড়ে গেছো সুখ-দুঃখের কাতরানি
প্রকৃতির মারে বসে আছি জোড়পাণি
বল হেসে বল কোথাও কি আছে ক্ষমা?
নির্দয় দেশে তুমিই তো প্রিয়তমা। [বসন্ত বায়ু: চতুর্দশপদী]
প্রকৃতি ও নারীর উপমার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই ”আত্মার কুহুধ্বনি” কবিতায়
কত নারী কত ঘাটে কত বাটে মাঠে তেপান্তরে
আমাকে তাদের বশীকরণের ফুঁৎকারে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে।
আমি কেঁপেছি ঠিকই,
কিন্তু এক দৈব নির্দেশের মতো আমার ভেতরের কোকিল
আমাকে ডাকতে ডাকতে পার করে নিয়েছে তেপান্তরের মাঠ থেকে ।
কত তুকতাক শেষ পর্যন্ত আমার হৃদয়কে গলিয়ে কাদা করে দিয়েছে
সেই কাদায় আমি যে পুতুল বানিয়েছিলাম তার নামই তো প্রেম,
আমি জনপদে থাকতে চেয়েছি।
কিন্তু কারা আমাকে এই অজ্ঞাতবাসে অরণ্যে বৃক্ষের সহোদর করে ঠেলে দিয়েছে?
গাছের চেয়ে নগ্নতা আমি কোন সৎপ্রাণ অস্তিত্বের মধ্যে অবলোকন করিনি।
একদিন আমি নিজেই গাছ হয়ে যাব।
প্রকৃতির সাথে কী এক মায়াজোড় ছিল কবি আল মাহমুদের! প্রকৃতির প্রেমে আজীবন জড়িয়েছিলেন তিনি। তাই তো তার পক্ষেই বলা সম্ভব হয়েছেÑ একদিন আমি নিজেই গাছ হয়ে যাব।
প্রেম, প্রকৃতি আর নারী সম্মিলনে এক চমৎকার উপমার বুনন আমরা লক্ষ্য করি কবি আল মাহমুদের ‘মাপজোক’ কবিতায়- আমাকে কতোটা উঁচু দেখায়, তা মাপতে গিয়েছিলাম,
কিন্তু যা কিছু সামনে ধরে দাঁড়াবার ছিল – পাহাড় পর্বত গাছ
কোন কিছুই আমার ভর সইতে পারলো না;
হেসে বললে- এই তো আমি তোমার ভর সইবার মত নগ্ন কাঁধ
তোমার টান সইবার মত উন্মুক্ত বাহু
আমি নারী, মাপো আমাকে;
[ মাপজোক ]
কী অসাধারণ ভাবের প্রকাশ! চিন্তার কী উৎকর্ষতা! আবেগের কী প্রাবল্যতা! শব্দের ব্যঞ্জনায় জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা নারীর কী চমৎকার উপস্থাপন কবিতার পয়ারে!
প্রকৃতি ও নারীর মাখামাখি কবি আল মাহমুদের কবিতাকে করে তুলেছে এক মায়াময় চেতনার বাহন। সে বাহনে চড়ে পাঠক অনায়াসে করতে পারে আবেগের জলে অবগাহন।
কিন্তু তাকে ছুঁয়ে দেখি এ আর মানবী নয়,
হয়ে গেছে একটি বেগুন রঙা অপরাজিতার নীল ফুল,
এর বেশি বসন্ত কোথায়?
এক স্তনে মাতৃদুগ্ধ, অন্য স্তনে রক্তবর্ণ। [বসন্ত বিবাদ]
দেশ জাতি নিয়ে কবি আল মাহমুদের মাঝে অনেক উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। যেমন “সীমানার কিনারায়” কবিতায় তিনি লিখেছেন
আলো আঁধারের খেলায় মত্ত এদেশ।
নীতি দুর্নীতির সংঘাত, হানাহানি, রক্তপাত, এসবই কবিকে করে তুলেছে বিচলিত। শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো রক্তপাত থামেনি। তাই তো কবির উদ্বেগ Ñ
হারিয়ে গেছে ভাষা আমার, আশা আমার থরথরিয়ে
ঘামের বিন্দু কামের বিন্দু যায় জড়িয়ে
তবুও আমি উত্তেজনায় কাঁপছি একা
হাত খুলে কি পাবো সে মুখ অশ্রু লেখা
নামটি তোমার সজল কোন দিনের মতো
বাজছে কেন কালের ধ্বনি বীণের মতো
এবার এসো খুলবো মুঠি সোনার টাকা
আমার হাতের মুঠোর ভেতর রক্তমাখা। [কররেখা]
ডান-বাম আর আল মাহমুদÑ এই নিয়ে বিস্তর তর্ক হয়েছে, বাদানুবাদ হয়েছে। কিন্তু কেবল সোজা ও সরল পথের পথিকই ছিলেন কবি আল মাহমুদ। ভিন্ন পথে যত লোভ লালসাই থাকুক না কেন, সরল পথই মানুষের মুক্তির প্রকৃত পথ- এ কথা তিনি ভাল করেই জানতেন। তাই তো সোজা ও সরল পথেই কবির গমনÑ
আর নয় ডানে, আর নয় বাম দিকে
সমে যেতে হবে সমে
হৃদয় কাঁপছে, মাথাও কম্পমান
তবু হুঁশিয়ার নিঃশ্বাস ধাবমান
পিছে পড়ে থাকে ফুলের রাজ্য, পুষ্পের সম্মান। [আজ বিজয়ের দিন]
জীবন আর মৃত্যু নিয়েই এই জগত। প্রতিটি প্রাণীকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। তবে মৃত্যুর আগে জীবনের অনেক কথা থাকে, কাহিনী থাকে, থাকে গৌরবময় স্মৃতি। সুখ-দুঃখ হাসি কান্না মিলেই মানব জীবন। জীবনের মাঝে কবি যেন শুনতে পেতেন মৃত্যুর সুর
একটা অদৃশ্য বাজনা বাজে আমার মধ্যে
এ¯্রাজ। মৃত্যুর কথা ভাবলেই
ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে ভেতরের তার জীবনের কথাও।
এ কোন মানুষ নয়,
আসলে এ হলো গুঞ্জরিত মৌমাছির বাসা,
মধু ও হুলের বিষ জমা হচ্ছে তার অস্তিত্বের কাঠামোতে। [অদৃশ্য এস্রাজ]
আমরা মৃত্যুর কথা ভুলে থাকি। জীবনের কোলাহলে ব্যস্ত সবাই। মৃত্যু আর জীবনের সম্বল মাত্র কিছু স্মৃতি, তাই নিয়ে এত মাতামাতি। স্মৃতির পাশাপাশি জড়িয়ে আছে কত না আক্ষেপ! এই দেশ এক সময় অনেক সমৃদ্ধশালী ছিল! গোয়াল ভরা গরু ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল। মানুষের মুখ ভরা হাসি ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন অনেক কিছুই হারিয়েছি আমরা। এখন আগের মত শান্তি নেই, মানুষে মানুষে মিল মহাব্বত নেই। এখন সব কিছুতেই ভেজাল । কোন কিছুই আর খাঁটি নেই। তাই তো কবির কলমে আক্ষেপের সুর-ফেরার কথা বলে না কেউ ঢেউয়ের মতন মুখ
বুকের ভেতর জমিয়ে রাখে গোপন করা সুখ।
ফেরার কথা আমিই বলি আমার ঠিকানায়
আমার আছে পেছন দিকে নিজের কিছু দায়।
কত কালো চোখের ভেজা উপচানো কাজল
ভাসায় আমার বাস্তুভিটা স্মৃতির সম্বল।
কোথায় পাব ঘরবাড়ি আর হারানো আশ্রয়?
কোথায় গেলে পাবো সেই সুখের মতন ভয়!
কে আর বলো এগিয়ে দেবে গরম ভাতে ঘি
সবকিছু তো পথের বাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। [দিন ফুরোলে]
পরিশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, প্রকৃতি ও নারী, মাটি ও মানুষ, পানি ও বায়ু- সবই যেন একাকার হয়ে মিশে আছে কবিতার স্বার্থক রূপকার কবি আল মাহমুদের কবিতায়। তার কবিতার ক’টি চরণ-
গুল্মগন্ধি তোমার শাড়ি বনবিটপির ঘ্রাণ,
আকুল করে ব্যাকুল করে লুটালো সম্মান।
গান বেঁধেছি একতারাতে প্রাণের পাখি গায়,
ওলো সোনার ডানার পালক আমার বুকে আয়।
লাগছে ছোঁয়া শীতলতার গীতলতার রেশ,
যেন তোমার ভাঙা খোঁপার হাওয়ায় কাঁপা কেশ।
কোথাও তবে পৌঁছতে হবে কোথায় তোমার ঘর,
শঙ্খ নদীর বাঁক ঘুরেছি, সামনে বিরাট চর।
[ছোঁয়া]
লেখক: কবি