স্বকালবিদ্ধ যুগন্ধর এক কবি নজরুল। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে বিদ্রোহী প্রমিথিউসের মতো তার আবির্ভাব। তিনি কেবলমাত্র যুগন্ধরই নয়, যুগোত্তীর্ণও বটে। যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার গগনচুম্বী প্রতিভার উত্তাপ ও উজ্জ্বলতা নিয়ে পূর্ণতেজে জ্বাজল্যমান, ঠিক তখনই বাংলা সাহিত্যের মহাকাশে উদিত হলেন নজরুল ইসলাম। তাঁর বিদ্রোহী ঝঞ্জাক্ষুব্ধ উত্তাল উত্তপ্ত জীবন বাণী ও বীণা নিয়ে, বাজালেন অগ্নিবীণা, শোনালেন বিষের বাঁশি, গাইলেন শেকল ভাঙার গান-বাঙালি সমাজ তাঁকে বরণ করে নিল তাদের কাক্সিক্ষত কণ্ঠস্বর হিসেবে।
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী ও প্রেমিক কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদিও তিনি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট হয়ে আছেন তাঁর বিদ্রোহ ও প্রেম উভয়কে নিয়েই। নজরুল নিজেই তার কবিতায় বলেছেন,
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী
আর হাতে রণতূর্য।”
নজরুলের কাব্যগুলোরও দু’টি পর্যায় রয়েছে বিদ্রোহ ও প্রেম। একদিকে আছে তাঁর অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, প্রলয় শিখা ইত্যাদি। অন্যদিকে আছে দোলন চাঁপা, চক্রবাক, ছায়ানট, পুবের হাওয়া ইত্যাদি।
বিদ্রোহী কবি হিসেবে নজরুলের কবিতায় যে নতুনত্ব আমরা পাই প্রেমের ক্ষেত্রে তা পাই না একথা অনস্বীকার্য প্রেমিক কবি নজরুলের সঙ্গে বাংলা কাব্যের হাজার বছরের গীতি ধর্মিতা একটি অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষ করে ঊনিশ শতকের বিহারীলালের হাতে যে গীতি কবিতার উদ্ভব রবীন্দ্রনাথের হাতে যার শ্রেষ্ঠ পরিণতি নজরুল তারই যোগ্য উত্তরসাধক। ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রেমের যে রোমান্টিক বিষণœতার শুরু বিহারীলালের অন্তরঙ্গ গীতি কবিতায়, আর উৎকর্ষ রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, মোহিত লাল মজুমদার যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হেজ প্রেমের উত্তাপ, নজরুলের প্রেমের কবিতা সে ধারারই অন্তর্ভুক্ত”।
(কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা)
বাংলা কাব্য সাহিত্যে প্রেমের পরিণয়ে সবসময়ই বিরহকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বেশি। নজরুল কাব্যেও আমরা দেখি তাঁর রোমান্টিক কবিসত্ত্বার সাথে বিরহ-বেদনা একাত্ম হয়, নিসর্গের অভিন্ন উপলব্ধিতে। যেমন তাঁর ‘চক্রবাক’ কাব্যে প্রিয়া ও প্রকৃতি একাকার। এখানে বিপ্লবী কবির বজ নির্ঘোষ শোনা বারণ < শোনা যায় না তাঁর সোচ্চার উক্তি। এখানে ওঠে সারেঙ্গীর টুং টাং, গজলে গুণ গুনানী, আছে সজল মেঘের ছায়া, কর্ণফুলীর ছলছল ব্যথা, চক্রবাক চক্রবাকীর মুখর বিরহ। সেদিক থেকে নতুন শুধু নয় অভিনব। নজরুল তার কবিতায় প্রিয়াকে তুলে ধরেছেন গতানুগতিকের বাইরে শৈল্পিক সৌন্দর্যের আবহে। এখানে নিসর্গের একাকীত্বের সাথে কল্পলোকের অপূর্ব অপূর্ব সম্মিলন। শুধু তাই নয় নজরুলের নিজস্ব বর্ণনাশৈলী বাংলা কাব্য ধারায় এনেছে এক নতুন সংস্করণ।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে প্রেম মূলত রোমান্টিক, যেখানে প্রেম স্বর্গীয়, জগৎ জীবন নিরপেক্ষ। প্রেমিকা কল্পনাপ্রসূত অর্ধেক মানবী, অর্ধেক কল্পনা। প্রেমিকার সাথে দৈহিক মিলন অনাকাঙ্খিত নয় এবং প্রাত্যহিক মালিন্যে প্রেমের স্বপ্নলোক ম্লান হওয়া অনুচিত। মিলন অপেক্ষা বিরহই শ্রেয় এবং বিরহই হলো চরম সান্তনা লাভের পথ। নজরুল জন্ম রোমান্টিক। ফলে তাঁর কাব্যে বেদনাবিলাস বেশী ‘চক্রবাক’ কাব্যে নজরুলের অসংযত আবেগ সংহতি লাভ করেছে। নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ কাব্যে কবি উপলব্ধি করেছেন- প্রেমের জগতে প্রাপ্তি নয় বরং অপ্রাপ্তি, মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য, শাশ্বত প্রাপ্তি। এ কাব্যের প্রধান উপজীব্য প্রেম-বিরহ। কাব্যের কোন কোন কবিতায় তিনি চক্রবাক-চক্রবাকীর প্রেম বিরহের প্রতীকে নর-নারীর বিশেষত আপন বিরহের কথাই আভাসিত হয়েছে। ‘ওগো চক্রবাকী, চক্রবাক, বাদল রাতের পাখি।’ তোমাকে পড়েছে মনে, ‘স্তব্ধ রাতে’, ‘তুমি মোরে বলিয়াছ, সাজিয়াছে বর মৃত্যুর উৎসব’, ‘অপরাধ শুধু মনে থাক’, ‘গানের আড়াল’ সহ অন্যান্য কবিতাগুলোতেও উপজীব্য বিষয় প্রেম এবং প্রেমের কারণে দুঃখ, বেদনা ও বিরহ।
নজরুল কাব্যে প্রেমের মূল সুর বিরহ। প্রেমিক কবি নজরুলের এটিই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যে কবি বিদ্রোহের ক্ষেত্রে মারমুখী, আপোসহীন প্রেমের ক্ষেত্রে তিনিই একেবারে শিশুর মতো অসহায় অবুঝ। কান্নার আর্তি ছাড়া তার আর সঞ্চয় নেই। এটি কি নজরুল কবি মানসের এক ধরনের স্ববিরোধ? প্রকৃত পক্ষে তা নয়। নজরুল হৃদয়ধর্মী কবি, আবেগ প্রধান কবি, সংবেদনশীল কবি। যে বঞ্চনা বোধ থেকে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী সেই বঞ্চনাবোধই কবিকে প্রেমের ক্ষেত্রে করেছে চিরবিরহী। নজরুল সহজ সরল অকপট কবি। তিনি যে পূজা ¯্রষ্টা ভগবানকে দেননি। তাই দিয়েছেন প্রিয়াকে। কিন্তু সেই প্রিয়ই যখন কবিকে দিয়েছে বেদনা, তখন তিনি যদিও আপাত ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু হৃদয়ের দিক থেকে ভেঙ্গে পড়েননি। না পাওয়ার বেদনা ও পেয়ে হারানোর বেদনা দুটিই নজরুলের প্রেমের কবিতায় একটি মানবিক বেদনার সৃষ্টি করেছে। প্রিয়া হারিয়ে গেছে তাই বলে প্রেম হারিয়ে যায়নি। নজরুল প্রিয়ার স্মৃতি মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন তার হারানো প্রেমকে।
চক্রবাক কাব্যের সবকটি কবিতার মধ্যে আমরা নজরুলের প্রেমানুভূতির সঙ্গে এ নিসর্গ চেতনার সমন্বয় দেখি। ‘ওগো চক্রবাকী’ কবিতায়-“ওগো চক্রবাকী তোমারে খুঁজিয়া অন্ধ হল যে চক্রবাকের আঁখি কবি তাঁর প্রিয়াকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তিনি বলেন, “যখন প্রভাতে থাকিব না আমি এই যে নদীর ধারে, ক্লান্ত পাখায় উড়ে যাব দূরে বিস্মরণীর পারে। খুঁজিতে আমার এই কিনারায় আসিবে যখন তুমি খুঁজিবে সাগর মরু প্রান্তর গিরি দড়ি বন ভূমি”
‘তোমারে পড়িছে মনে, বাদল রাতের পাখি’ স্তব্ধ রাতে ইত্যাদি।
কবিতায় কবি ব্যথা ভাবাতুর। প্রকৃতি তার বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। কবির বেদনা হয়েছে বিশ্বগত-
“এপারে ওপারে মোরা, নাই নাই কুল
তুমি দাও আঁখি জল, আমি দেই ফুল।”
কবির বেদনার সঙ্গি বাদল রাতের পাখি, কবি তাকে বলেন- বাদল রাতের পাখি উড়ে চল যথা আজো জল, নাহিকো কুলের ফাঁকি।
থেমে আসে রজনীর গীত কোলাহল, কবির মনেও নেমে আসে প্রিয়ার স্মৃতি। আকাশে শিশির ঝরে, বনে ঝরে ফুল। কবি তার সাথিকে বলেন,-
“এই বার তুই নেমে আয় অতন্ত্র নয়ন পাতায়।”
রোমান্টিক কবি নজরুলের কবি কল্পনায় আমাদের মুগ্ধ করে। ‘কর্ণফুলী’ কবিতায় কবি কর্ণফুলী ঢেউয়ের মধ্যে দেখেন আপন বেদনার ঢেউকে। কর্ণফুলী একটি নদী মাত্র নয়-
তুমি কি পদ্মা হারানো গোমতি, ভুলে যাওয়া ভাগীরথী
তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতি?
কবির মনে হয়েছে কর্ণফুলীও বিরহিনী। তার ¯্রােতে কোন পাহাড়ের আঁখি জল। কঠিন পাহাড় যা ঝড়ে বজ্রে টলেনি। অথচ বেদনায় গলে গলে নদী হয়ে যায়, যে জল ফুরায় না কখনো, সে যেতে চায় সমুদ্র সংগমে সমুদ্র তাকে জোয়ারে ফিরিয়ে দিলেও ভাটায় সে আবারও যেতে চায়। প্রেমিক হৃদয় এমনই যারে চায় শুধু তারেই চায়। আগুনে পতঙ্গ পুড়লেও সে কেবল তারই পাশে ঘুরে।
প্রেম মানব জীবনের একটি মৌলিক ও প্রবল অনুভূতি বলে নজরুল কাব্যে বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অবস্থান। মানুষের আর অনুভূতির ন্যায় প্রেম জটিল, পরস্পর বিরোধী। প্রেমের মহিমান্বিত স্পর্শে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, আবার প্রেমের বেদনা মানুষকে রিক্ততার অর্তলান্ততায় নিক্ষেপ করে। প্রেমের প্রকাশও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। নজরুলের প্রেমে মূলত বিরহই প্রাধান্য পেয়েছে সবসময়। নজরুল তাঁর কাব্যে প্রিয়াকে দেখেছেন হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে। তাঁর কাব্যে মানবিক ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি লাভ করেছে নিসর্গের চেতনার সঙ্গে কবির প্রেমানুভূতির অভিন্ন উপলব্ধিতে। নজরুল প্রেমের কবি হিসাবে বাংলা রোমান্টিক গীতি কাব্য ধারায় অমর হয়ে আছেন। কবি বিরহকে কবি সত্তার মৌল ব্রত, পরম প্রেরণা হিসাবে আবিস্কার করেছেন। তিনি সব হারালেও হৃদয় হতে তাঁর প্রেমকে, প্রিয়াকে হারাতে চাননি। তাই প্রিয়া তাঁর নিত্যকালে। প্রিয়ার কাছ থেকে প্রেম না পেলেও বলেছে-
“নাই বা পেলাম কণ্ঠে আমার তোমার কণ্ঠ হার
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার”
এখানেই নজরুল ইসলামের বিরহী কবি সত্তার সর্ব্বৈ সার্থকতা ॥
সহায়ক : ১. নজরুল রচনা সমগ্র ১ম খ–বাংলা একাডেমি। ২. নজরুল সাহিত্যে ধর্ম- ড. হারুন-উর-রশিদ। ৩. কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা-ড. রফিকুল ইসলাম। ৪. সাহিত্যের কাল ও কালান্তর-মাহবুবুল আলম।
৫. সাহিত্যের কাল ও কালান্তর-ড. সফিউদ্দিন আহমদ। ৬. নজরুল কবি মানস-ড. মোস্তফা নুরুল ইসলাম (সম্পাদিত)।