একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় পৃথিবীতে নেমে আসছে। মহামারী, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও দাবদাহ একটির পর আরেকটি জনপদের পর জনপদকে কাঁপিয়ে তুলছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস দুই বছরের অধিক ধরে পৃথিবীকে অস্থির করে তুলেছে; যার তা-ব এখনো থামেনি। এখন চলছে অনাবৃষ্টি ও প্রচ- গরম-দাবদাহ। ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল ও আফ্রিকার এক বড় অংশজুড়ে চলছে দাবদাহ। তীব্র দাবদাহের ফলে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল, যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্রিটেনের ইতিহাসেও এত গরম কখনো পড়েনি। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পাশাপশি জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও বৃষ্টিপাতের অভাবে আবহাওয়া রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে, যার ফলে গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। নজিরবিহীন এ গরমের তীব্রতায় কয়েক শ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আরো বহু মানুষ মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কারণগুলো- ১. জুলুম : যখন কোনো জনপদে জুলুম-নির্যাতন বেড়ে যায়, তখন সেই জনপদে আল্লাহর আজাবগুলো একটির পর একটি নেমে আসে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জালেমদের কর্মকা- সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না।আল্লাহ তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন, যেদিন চুগুলো বিস্ফারিত হবে, তারা মাথা নিচু করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হৃদয়গুলো দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আজাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। সেদিন জুলুমবাজরা বলবে- হে আমাদের প্রভু! অল্প কিছু দিন আমাদের সময় দিন, তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করব এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। তোমরা কি এর আগে কসম খেয়ে খেয়ে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা তোমাদের বাসস্থানেই বসবাস করছ এবং সেসব জালিমদের সাথে আমি কী আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪১-৪৫) আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে থাকে। জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।’ (সূরা শুরা-২২৭) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তার পর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন- তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
২. স্বহস্তের উপার্জন : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়, হয়তো তারা বিরত ফিরে আসবে।’ (সূরা রুম-৪১)
মানুষের স্বহস্তের উপার্জন অর্থ হচ্ছে ফাসেকি, অশ্লীলতা, জুলুম ও নিপীড়ন এবং অবাধ্যতা, কুফরি ও পাপাচারের কারণে কখনো কখনো মহান আল্লাহ তায়ালা এসব দুর্যোগ দিয়ে সতর্ক করেন; যাতে তারা আখিরাতের শাস্তি লাভ করার আগে আল্লাহ এ দুনিয়ায় মানুষের সব নয় বরং কিছু খারাপ কাজের ফল এ জন্য ভোগ করান যে, এর ফলে সে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করবে এবং নিজের চিন্তাধারার ভ্রান্তি অনুধাবন করে সঠিক পথে চলে আসে। হজরত উম্মু সালমা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন জমিনে মন্দ কাজের প্রাবল্য দেখা দেবে, তখন আল্লাহ তায়ালা জমিনে বসবাসকারীদের ওপর নিজের আজাব নাজিল করবেন। হজরত উম্মু সালমা রা: বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদিও তাদের মধ্যে নেক লোক তবুও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যদিও তাদের মধ্যে নেক লোক থাকে। সাধারণ লোকদের মতো তারাও শাস্তিতে নিপতিত হবে। পরে আল্লাহ তাদের তাঁর রহমতের দিকে টেনে নেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
৩. উপলব্ধি ও ফিরে আসার সুযোগ : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেই বড় আজাবের আগে আমি দুনিয়াতে তাদেরকে কোনো না কোনো ছোট আজাবের স্বাদ ভোগ করাতে থাকব। হয়তো এরা তাদের বিদ্রোহাত্মক আচরণ থেকে বিরত হবে।’ (সূরা আস সাজদা-২১)
৪. কয়েকটি গুনাহ তার কুফল : হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- যে সম্প্রদায় মাপে কম দেয় ও ওজনে কম করে আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দেন। আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীলতা ও কুকর্ম বৃদ্ধি পায়, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। আর যে সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদি লেনদেন বেড়ে যায়, আল্লাহ তাদের মধ্যে পাগলামি ও মস্তিষ্ক বিকৃতি বৃদ্ধি করে দেন। যে সম্প্রদায়ের মধ্যে হত্যা ও খুন-খারাবি বেড়ে যায়, তখন তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা তাদের দুশমনদের চাপিয়ে দেন। যে সম্প্রদায়ের মধ্যে লুত আ:-এর সম্প্রদায়ের কাজ (সমকামিতা) হতে থাকে, তাদের মধ্যে ভূমিধস হওয়া ব্যাপক হয়ে যায়। যে সম্প্রদায় সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ পরিত্যাগ করে, তাদের আমল ও কাজকর্মের উন্নতি হয় না এবং তাদের দোয়া কবুল হয় না। (সুনানুল কুবরা : ৩/৩৪৬-৩৪৭)
৫. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বন্ধ থাকা : হজরত আয়েশা রা: বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা: আমার কাছে এমন অবস্থায় আগমন করলেন, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছিল। তিনি এসে কোনো কথা বললেন না। এরপর তিনি অজু করলেন এবং বাইরে বের হলেন। আমি হুজরায় বসা ছিলাম। তিনি মিম্বরে উঠে আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করে বললেন, হে লোকসকল! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বলেছেন যে, তোমরা নেককাজের আদেশ করো আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো, সেই সময় আসার আগে যখন তোমরা আমার কাছে দোয়া করবে আর আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব না। তোমরা আমার কাছে চাইবে আর আমি দান করব না। তোমরা আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে আর আমি তোমাদের সাহায্য করব না।’ (ইবনে মাজাহ-৪০০৪)
হজরত কায়েস বিন আবু হাতিম বলেন, একবার হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: এই আয়াত পাঠ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা করো। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে ভ্রান্ত পথ রয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সূরা মায়িদা-১০৫) এবং বলেন, লোকেরা এ আয়াতটির যথাযথ অর্থ করতে পারে না। অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি- যে সম্প্রদায় কোনো জালিমের জুলুম দেখেও তার হাতকে বাধা দেয় না অথবা কোনো অন্যায় ও পাপকাজ দেখেও তা প্রতিরোধ করে না, তবে আল্লাহ তায়ালা তাদের তার শাস্তিতে নিপতিত করবেন।’ (ইবনে জারির তাবারি) ৬. পাঁচটি গুনাহের পরিণতি : হজরত ইবনে উমর রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে মুহাজিরদের ১০ জন ব্যক্তি বসা ছিল। তাদের মধ্যে আমি ছিলাম দশম ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর চেহারা মোবারক ঘুরিয়ে আমাদের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং বললেন, ‘হে মুহাজির সম্প্রদায়! পাঁচটি স্বভাব এমন যা থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই যাতে তোমরা তাতে পতিত না হও-
এক, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা সাধারণ বিষয় হয়ে যায় এবং মানুষ তা প্রকাশ্যে করতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ এবং এমনসব রোগব্যাধি প্রকাশ পায়, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনো হয়নি। দুই, আর যে সম্প্রদায় মাপে ও ওজনে কম দেবে, তারা দুর্ভিক্ষ, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বাদশাহ ও শাসকদের অত্যাচারের শিকার হবে।
তিন, আর যে সম্প্রদায় জাকাত দেয়া বন্ধ করে দেয় তারা বৃষ্টির রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। যদি জন্তু-জানোয়ার না থাকত তবে একেবারেই বৃষ্টি হতো না। চার, আর যে সম্প্রদায় চুক্তি ভঙ্গ করবে তাদের ওপর তাদের দুশমনদের প্রবল করে দেয়া হয় যারা তাদের মাল-সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।
পাঁচ, আর যে সম্প্রদায়ের শাসকরা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানের ওপর আমল করে না এবং কুরআনের হুকুম-আহকামকে মূল্যায়ন করে না তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও শাস্তিতে জড়িয়ে দেন।’ (মুস্তাদরাক হাকিম)
৭. দুনিয়া হাসিল করার ধান্ধা : আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘শেষ জামানায় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে যারা দ্বীনের নামে দুনিয়া হাসিল করবে। লোকদের দেখানোর জন্য সুফি বেশ ধারণ করবে। তাদের জবান হবে চিনির চেয়েও মিষ্ট, অথচ তাদের অন্তর হবে নেকড়ে বাঘের মতো।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি আমাকে ধোঁকা প্রদান করো অথবা দুঃসাহস দেখাও? আমার নিজের সত্তার কসম! আমি তাদের ওপর এমন ফিতনা ছড়িয়ে দেবো যা তাদের মধ্যে সহনশীল-বুঝমান লোককেও হয়রান-পেরেশান করে তুলবে।’ (তিরমিজি, কিতাবুল জুুহদ)
পরিত্রাণের উপায় : খুব দ্রত তাওবা করে আল্লাহর রহমতের সীমানায় প্রবেশ করতে হবে। অবশ্যই আমরে বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অপরিহার্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। জমিনে ছড়িয়ে পড়া সব প্রকার অশ্লীল ও বেহায়াপনার মূলোৎপাটন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় জুলুমসহ সব প্রকার জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। করুণার আধার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফিরে আসার সদর দরজা খুলে রেখেছেন। সুতরাং তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টির সীমানায় দ্রুত চলে আসুন। তাওবা করুন, ফিরে আসুন।