বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে মনমাতানো ক্লাস পার্টি অনুষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান অধ্যাপক ইউনূসের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ প্রধান বিচারপতির দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত থেমে নেই: তারেক রহমান তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সাথে জামায়াতের সৌজন্য সাক্ষাৎ চিন্ময় সমর্থক জঙ্গীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ: চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের উদ্যোগ শাপলা চত্বরে গণহত্যায় হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা চাই না ছাত্র ভাইদের কঠোর হয়ে দমন করতে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরিয়া অনুসরণে প্রতিবন্ধকতা

ড. ইকবাল কবীর মোহন
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২

ইসলামী ব্যাংকিং ইসলামী অর্থনীতি কায়েমের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। শরিয়ার অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সব কাজে শরিয়ার বিধি-বিধান প্রয়োগের যথার্থ পন্থা উদ্ভাবন ও কার্যকর করার চেষ্টা চালু হয়েছে। তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সব পর্যায়ে ইসলামী বিধানের পুরোপুরি প্রয়োগ এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
এর মধ্যে মানি মার্কেট, পুঁজি বাজার, বৈদেশিক মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলো এসব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। যেসব ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিনিয়োগের সময় ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করা, মালামাল গ্রাহককে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন করছে। এ জন্য ব্যাপকভিত্তিক শরিয়া নিরীক্ষা নিয়মিত চালু আছে। শরিয়া লঙ্ঘনের জন্য ব্যাংকে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। তার পরও নানা কারণে শরিয়া লঙ্ঘিত হতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরিয়া লঙ্ঘনের প্রকৃতি ও ধরন: ইসলামী ব্যাংকে নানাভাবে শরিয়া লঙ্ঘিত হতে পারে। বিনিয়োগব্যবস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যাংক অনেক সময় ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি করে থাকে। তার মধ্যে নিচে বর্ণিত কারণগুলোর জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রমে শরিয়া লঙ্ঘিত হয়ে থাকে। শরিয়া লঙ্ঘনের কয়েকটি কারণ নিচে আলোচনা করা হলো
ক. ক্রয়-বিক্রয় না হওয়া : ক্রয়-বিক্রয় হওয়ার জন্য পণ্যের আদান-প্রদান হতে হবে। পণ্য যদি না থাকে শুধু টাকা ঋণ দিয়ে টাকা নেওয়া সুদ ছাড়া আর কিছুই নয়। ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দুটি পক্ষ থাকতে হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতা। কেউ যদি তার নিজের মাল নিজের কাছেই বিক্রি করে, তবে ক্রয়-বিক্রয় হবে না এবং তা শরিয়াসম্মতও হবে না।
খ. ক্যাশমেমো না থাকা : ক্যাশমেমো ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো শর্ত নয়, তবে ক্রয়-বিক্রয় প্রমাণ করার জন্য এটি জরুরি বিধায় এর অনুপস্থিতি ক্রয়-বিক্রয়কে সন্দেহযুক্ত করে তোলে।
গ. ব্যাংক মাল বুঝে না পেয়ে বিক্রি করা : অনেক সময় বিক্রেতার কাছ থেকে ব্যাংক মাল ক্রয় করে ঠিকই; কিন্তু ক্রয় করার পর তা নিজের নিয়ন্ত্রণে না এনেই সরাসরি গ্রাহকের কাছে বিক্রয় করে দেয়। ফলে বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যাংকের কাছ থেকে মালামাল গ্রহণ না করে সরাসরি বিক্রেতার কাছ থেকে গ্রহণ করে, যা শরিয়াসম্মত নয়। কোনো দ্রব্য বা পণ্য বিক্রি করার জন্য পণ্যটি বিক্রেতার পূর্ণ মালিকানায় থাকা জরুরি। পূর্ণ মালিকানা অর্জনের জন্য দ্রব্য বা পণ্যের ওপর মালিকের কবজা বা নিয়ন্ত্রণ থাকা শর্ত। এই নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ করার জন্য দ্রব্যটি নিজের দখলে আনা এবং সামান্য সময়ের জন্য হলেও ঝুঁকি গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে দ্রব্য বা পণ্যের মালিক না হয়েই তা বিক্রয় করার সমতুল্য হবে, যা শরিয়াসম্মত নয়।
ঘ. ক্যাশমেমো আগের অথবা পরের তারিখের : ক্যাশমেমো ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ক্যাশমেমো যদি আগের তারিখের হয় এবং ব্যাংকের নামে হয় তবে দোষের কিছু নেই। কারণ ব্যাংক মাল আগে ক্রয় করে পরে বিক্রয় করছে। কিন্তু ক্যাশমেমো যদি বিনিয়োগগ্রহীতার নামে এবং আগের তারিখের হয় তবে বোঝা যাবে যে-ই ব্যাংক মাল ক্রয়ই করেনি। সুতরাং মাল বিক্রয় করারও প্রশ্ন আসে না। এতে আরো প্রমাণিত হয়, বিনিয়োগগ্রহীতা আগে নিজেই মাল ক্রয় করেছিল এবং ব্যাংক তাকে ওই টাকাই পরিশোধ করছে, যা শরিয়ার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ঙ. এলসি ও এলটমেন্টের বেলায় অথরাইজেশন না নেওয়া : এলসি খোলার জন্য আইআরসি ও এলটমেন্ট পত্র থাকে গ্রাহকের নামে। এ ক্ষেত্রে মাল আমদানি করলে বা এলটমেন্টের বিপরীতে মালামাল ক্রয় করলে মালের মালিক হন গ্রাহক নিজে। এ অবস্থায় মালামাল আবার গ্রাহকের কাছেই বিক্রি করা শরিয়াসম্মত নয়। এসব ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে অথরাইজেশন নিয়ে ব্যাংক মালামাল নিজে আমদানি করবে এবং এলটমেন্টের মালের মালিক হবে এবং পরবর্তীকালে তা বিক্রি করবে, তা না হলে শরিয়াসম্মত হবে না।
চ. এলসির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে মুনাফা ধার্য করা : ক্রয়-বিক্রয় শরিয়াসম্মত হওয়ার জন্য মালের ওপর মুনাফা একবারই ধার্য করা যেতে পারে। সময় বা অন্য কিছুর কারণে তার বিক্রয়মূল্য পরিবর্তন করা যাবে না। এলসির ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধের সময় একবার এবং পরবর্তী সময় কাস্টমস ডিউটি বা অন্যান্য খরচের সময় পুনরায় মুনাফা ধার্য করলে তা শরিয়াসম্মত হবে না। কারণ দ্রব্যমূল্য একবার নির্ধারণ করার পর তা পুনরায় বাড়ানো যায় না।
ছ. অবকাশকালীন সময়ে ভাড়া নেওয়া : হায়ার পারচেজ বিনিয়োগের বেলায় গ্রাহককে তার বিনিয়োগ পরিশোধ শুরু করার আগে তাকে একটি অবকাশকালীন সময় দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যে বাড়ি, গাড়ি বা মেশিনপত্র ভাড়া দেওয়া হবে, তা ব্যবহারযোগ্য হওয়ার আগে তার থেকে ভাড়া আদায় করা বৈধ নয়।
জ. মুশারাকার ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা নেওয়া : মুশারাকা ব্যবসায়, ব্যবসাটি শেষ হওয়ার পর হিসাব চূড়ান্ত করা হয় এবং হিসাব অনুযায়ী লাভ হলে চুক্তিতে নির্ধারিত হারে লাভ বণ্টন করা হয় এবং ক্ষতি হলে পুঁজির অনুপাতে গ্রাহক ও ব্যাংক ক্ষতি বহন করে। কিন্তু ব্যাংক যদি তার বিনিয়োগের অর্থের ওপর পূর্ব নির্ধারিত হারে মুনাফা নেয় এবং লাভ-ক্ষতির হিসাবের তোয়াক্কা না করে, তবে তা শরিয়াসম্মত হবে না।
শরিয়া লঙ্ঘনের কারণ: শরিয়া লঙ্ঘনের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়া পালন করতে গিয়ে নানা ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছে। তবে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ব্যাংকগুলোও যে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে, তাও সত্য। যেসব পরিস্থিতির জন্য শরিয়া লঙ্ঘিত হচ্ছে নিম্নে তার কতিপয় কারণ তুলে ধরা হলো :
ক. সুদি পরিবেশ : আমাদের অর্থনীতির পুরোটাই বলতে গেলে সুদনির্ভর। ব্যবসায়-বাণিজ্যে যারা রত আছেন তারাও সুদের সঙ্গে জড়িত। দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক সুদি কারবারে নিয়োজিত। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে শরিয়া মোতাবেক লেনদেন করা কঠিন।
খ. জ্ঞানের অভাব : সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য কী তা গ্রাহকদের অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। অনেক সময় সুদ বর্জনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পদ্ধতিগত জ্ঞানের অভাবে তা কার্যকর করা সম্ভব হয় না।
গ. কমিটমেন্টের ঘাটতি : সুদ যেহেতু হারাম, তাই কোনোভাবেই সুদের সঙ্গে জড়িত হওয়া যাবে নাÍএ জাতীয় দৃঢ় সিদ্ধান্ত অনেকেই রক্ষা করতে পারেন না। ফলে শরিয়া লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
ঘ. যেনতেনভাবে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা : আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুনাফা অর্জন ব্যাংকের একটি প্রধান টার্গেট। কিন্তু হালাল-হারামের বিচার না করে যেনতেনভাবে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা অনেকের মধ্যে কাজ করে বলে শরিয়া লঙ্ঘিত হয়।
ঙ. আখিরাতে জবাবদিহির দুর্বল অনুভূতি : সুদি কারবারের আয় হারাম, আর হারাম খেলে আখিরাতে শাস্তি অনিবার্য, তা জানলেও আমাদের অনুভূতি দুর্বল হওয়ার কারণে শরিয়া পালনে আমরা সচেতন নই।
লেখক : সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে, প্রধান ব্যবসায় উন্নয়ন ও শরিআহ সেক্রেটারিয়েট
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com