একটি ব্যবস্থা যখন ক্রমাগতভাবে স্বৈরতন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ ধারন করতে থাকে তখন তা কেবলমাত্র শাসনের ধরনের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকেনা। রাষ্ট্রের দৃশ্যত নিপীড়ক যন্ত্রগুলোর আধিপত্যই এই ব্যবস্থার একমাত্র চিহ্ন নয়, এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার কাজে, তার অন্যায় আচরণকে বৈধতা দেবার কাজে এগিয়ে আসে রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বৈরতন্ত্র অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে তার করতলগত করে যে এগুলোর কাজ হয়ে পড়ে আইনি-বেআইনিভাবে এক ধরণের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের প্রতিদিনের জীবনাচারনের ওপরে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নিপীড়ক যন্ত্রগুলো যেমন নাগরিকদের বলে দেয় তাঁরা রাজনীতিতে কতটুকু সক্রিয় থাকতে পারবেন বা আদৌ পারবেন কিনা তেমনি বলে দেয় নাগরিকরা কী বলতে পারবেন, কী গাইতে পারবেন, কীভাবে গাইতে পারবেন। এই বলার কাজটিকে বাস্তবায়নের জন্যে যেমন নিপীড়ক বাহিনীরা সক্রিয় থাকে, তেমনি থাকে ক্ষমতাসীন দলের পেটোয়া বাহিনী – লাঠিয়াল, হেমলেট বা অন্য যে নামেই আপনি তাঁদের ডাকেন না কেন। আপনি কাওয়ালী গাইবেন নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত; নাকি নজরুল গীতির বিশেষ গায়কী আপনার জন্যে বরাদ্দ হবে সেটা বলার দায়িত্ব তাঁরা স্বেচ্ছায় নেন কিনা সেটা জানা যায়না তবে স্বৈরতন্ত্রের ম্যানূয়ালে সেটা লিপিবদ্ধ আছে বলেই প্রতীয়মান। আর এই সব কাজে তাঁদেরকে বাহবা দেয়ার জন্যেও আছে মানুষ – আপনার চারপাশেই, কখনো কখনো যারা সমাজে সমাদৃত।
যেটা লক্ষ করার এবং বোঝার বিষয় তা হচ্ছে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এগুলো ‘অন্য’দের সাথে হচ্ছে বলে আপনি নিষ্ক্রীয় থাকলেও তা আপনার ওপরে এক সময় জারি হবে এবং তা কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে – রাজনীতি, কথা বলা বা গান গাওয়ার সীমায় তা আটকে থাকবেনা। এক সময় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের বলবে কী পোশাক পরা যাবে আর কী পোশাক অগ্রহণযোগ্য। সক্রিয়তা, চিন্তা, মত প্রকাশ, গান গাওয়া এবং পোশাকের ওপরে নজরদারি, খবরদারি সমাজের ভেতরে স্বৈরতন্ত্র বিস্তারের প্রমাণ। এগুলোকে নৈতিকতার নামে, সংস্কৃতির নামে, ধর্মের নামে, শুদ্ধাচারের নামে হাজির করা হয়। কিন্ত তার পেছনে আছে নাগরিকের জীবনের ওপরে নিয়ন্ত্রনের খড়গ ঝুলিয়ে রাখার মানসিকতা।
খন্ড-বিখন্ড কিংবা প্রতীকী প্রতিবাদ করে এর মোকাবিলা করতে পারবেন এমন আশা করা ভুল। স্বৈরতন্ত্রকে মোকাবিলা করার পথ হচ্ছে রাজনৈতিক। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠানগুলো একই ধরণের আচরণ করে। আগে সেটা বোঝা দরকার। নাগরিকের অধিকারগুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট, এগুলোর একটা হারিয়ে ফেলার পরে নিরবতা অন্যগুলো হরণের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে দরকার হচ্ছে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নগুলোকে সামনে আনা, তার জন্যে লড়াই করা। [লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া।]