মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮নং কালিঘাট ইউনিয়নের ফিনলে টি কোম্পানীর লাখাইছড়া চা বাগানের উড়িষ্যা টিলার মাটি ধ্বসে চাপা পড়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়া চার নারী শ্রমিকের বাড়িতে কেবল শোক আর আর্তনাদ। নিহত নারীদের প্রত্যেকেরই আছে শিশু সন্তান। ওই চারজনের আকস্মিক মৃত্যুতে শুধুমাত্র নিহতদের স্বজনরাই নয়; পুরো চা বাগানজুড়েই চলছে শোকের মাতম। সাধারণ শ্রমিকদের কান্না যেন থামছেই না। ঘটনার পর থেকে শুক্রবার সারারাত ও রবিবার বিকেল পর্যন্ত নিহত চার শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দেবার জন্য জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, বাগানের সাধারণ শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ নিহতদের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। শনিবার সকালে চা শ্রমিকদের আহাজারিতে শেষবিদায় দেয়া হয় চার নারী শ্রমিককে। শেষকৃত্যের সময় স্বজনদের আর্তনাদ ও কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ, শোকবিহ্বল তারা। গত শুক্রবার বেলা ১১টায় টিলা ধ্বসে মারা যান এ চার নারী শ্রমিক। রবিবার (২১ আগস্ট) বিকেলে সরজমিনে ফিনলে টি কোম্পানীর লাখাইছড়া চা বাগানের স্কুল লাইনে অবস্থিত ওই চার শ্রমিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নিহত চা শ্রমিক পূর্ণিমা ভূমিজের ১ বছল ৩ মাস বয়সী অবুঝ শিশুপুত্র আউস ভূমিজ মা-মা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। তার কান্নায় বাড়িতে আগত সকলের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
কোনভাবেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। পূর্ণিমা ভূমিজের স্বামী রিপন ভূমিজ জানান, তার স্ত্রী বাগানের ক্যাজুয়াল শ্রমিক। তাদের দুই সন্তান। বড় সন্তান পিউস ভূমিজের বয়স ৫ বছর আর আউস ভূমিজের বয়স ১৫ মাস। এখন অবুঝ দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রিপন ভূমিজ। মাতৃহারা অবুঝ দুই শিশু সন্তানের কান্না সহ্য করার মতো নয়। নিহত হীরা রানী ভূমিজ ছিলেন লাখাইছড়া চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। তার দুই সন্তান। বড় সন্তান করণ ভূমিজ লাখাইছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণি এবং ছোট সন্তান নিখিল ভূমিজ ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। হীরার স্বামী স্বপন ভূমিজ আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র বসবাস করছেন। হীরা রানী ভূমিজ বাগানের স্থায়ী শ্রমিক হওয়ায় তার দৈনিক ১২০ টাকা হাজিরায় চলতো দুই সন্তানের লেখাপড়া ও ভরণপোষন। এখন দুই সন্তান যেন অকূল সাগরে। মাতৃহারা করণ ভূমিজ জানায়, মা হীরা রানী ভূমিজ বাগানের কাজে গেলে তাদের কাকি মা পূর্ণিমা ভূমিজ দুই ভাইকে দেখাশুনা করতেন। শুক্রবার তারা দুইভাই একসাথে মা ও কাকি মাকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায়। নিহত রীনা ভূমিজের পরিবারের তার স্বামী মিটুন ভূমিজ, স্বামীর বয়োবৃদ্ধ মা ও বাবা এবং তার ৯ মাস বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান রয়েছে। রীনা ভূমিজ ছিলেন বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। তার দৈনিক হাজিরা দিয়েই চলতো ৫ সদস্যের সংসার। শুক্রবার ঘটনার পর পুরো সংসারটি এখন তছনছ হবার পথে। শুক্রবার থেকে নিহত রীনা ভূমিজের ৯ মাস বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তানকে সামলাতে পুরো পরিবার হিমশিম খাচ্ছে। অবুঝ শিশুটি যাকেই দেখছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছে। অনবরত কান্না করেই যাচ্ছে শিশুটি। নিহত রাধা মাহালী বাগানের ক্যাজুয়াল শ্রমিক। তার স্বামী অরুন মাহালী স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের ৫ সন্তান। বড় সন্তান আকাশ মাহালী বাগানের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সভাপতি, দ্বিতীয় সন্তান বিকাশ মাহালী বেকার, তৃতীয় সন্তান নিঝুম মাহালী স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণি, চতুর্থ সন্তান প্রকাশ মাহালী ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সর্বশেষ সন্তান অভি মাহালীর বয়স ৩ বছর। অরুন মাহালী স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে পেতেন দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি আর নিহত রাধা মাহালী ক্যাজুয়াল শ্রমিক হিসেবে যা পেতেন তা দিয়ে কোনভাবে ৭ জনের সংসারে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ অন্যান্য খরচের যোগান হতো। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় নিহত রাধা মাহালীর স্বামী ও চার সন্তান রাধা’র বিয়োগ ব্যাথায় কাতর হলেও ৩ বছর বয়সী অভি মাহালী চারদিকে ছুটোছুটি করছে আর তার মাকে খুঁজছে। বাগানের শ্রমিক অজয় ভূমিজ দৈনিক খবরপত্র-কে জানান, নিহত চার নারী শ্রমিকের পরিবার আজ পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের পরিবারের অন্য কোন সদস্যদেরক বাগানের স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলে পরিবারগুলো বেঁচে যাবে। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮নং কালিঘাট ইউনিয়নের ফিনলে চা কোম্পানীর লাখাইছড়া চা বাগানে নারী শ্রমিক হীরা রানী ভূমিজ (৩০), রিনা ভূমিজ (২৫), পূর্ণিমা ভুমিজ (২৫) এবং রাধা মাহালি (৪৫) বাড়ির পার্শ্ববর্তী বাগানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত উরিষ্যা টিলায় ঘর লেপনের জন্য মাটি আনতে যান। টিলার নিচ থেকে মাটি সংগ্রহকালে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আকস্মিক টিলার উপরিভাগের কিছু মাটি ধ্বসে পড়লে ওই চার নারী চা শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার পরপরই অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি, জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ এমপি, শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ভানু লাল রায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শামীম-অর-রশীদ তালুকদার, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবীর, ৮নং কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালা, প্যানেল চেয়ারম্যান ও ১নং ওয়ার্ড সদস্য মো. আব্দুস সাত্তার এবং লাখাইছড়াসহ অন্যান্য চা বাগানের শত-শত শ্রমিক হাসপাতালে ছুটে আসেন। নিহত শ্রমিকদের সৎকার কাজের জন্য সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ তাৎক্ষনিক ২০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় চা বাগানের পক্ষ থেকে ৪টি পরিবারকে নগদ ১০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়া গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের উদ্যোগে নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকে ২৫ হাজার অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়।