শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:৫৯ অপরাহ্ন

তাকওয়া : দুনিয়ার লাভ

মুন্সি আবদুল কাদির:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

তাকওয়া মুমিনের শ্রেষ্ঠ গুণ। ঈমান ও তাকওয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ঈমান আনা থেকে তাকওয়ার পদচারণা শুরু হয়। মহান রবের মহান বন্ধুত্বে তার পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এই পূর্ণতাই তৃপ্তি। এই পূর্ণতাই লক্ষ্য। এই পূর্ণতাই চূড়ান্ত সফলতা। মুমিন বলতেই তাকওয়াবান। এই তাকওয়ার অনেক স্তর বিদ্যমান। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন সাজানোর অবিরত প্রচেষ্টা তাকওয়ায় মজবুতি আনে। এই নিরন্তর চেষ্টার মাধ্যমে মহান রবের সন্তুষ্টি সাধিত হয়। এই বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতায় তার দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন হয়, সুন্দর, সাবলীল ও সুখময়। আমাদের অনেক ক্ষেত্রে ধারণা, তাকওয়াবানদের দুনিয়ায় শুধু কষ্ট আর কষ্ট করতে হয়। আসলে আমরা কাকে প্রকৃত কষ্ট আর কাকে প্রকৃত সুখ বলে তাও চেনার চেষ্টা করি না। অনেক ক্ষেত্রে আমরা তাকওয়ার জীবনকে দরবেশি জীবন বলি। ইসলামের ইতিহাসে আমরা অনেক দৃষ্টান্ত পাবো যে বাদশাহী ছেড়ে আরামের জীবন ছেড়ে দরবেশ হয়ে গেছেন। কিন্তু দরবেশ জীবন ছেড়ে বাদশাহী জীবন গ্রহণ করেছেন, এমন একটি উদাহরণও কি পাবো? কারণ দরবেশি জীবনের আত্ম প্রশান্তি বাদশাহী জীবনে পাওয়া যায় না। তাই তো ইবরাহিম ইবনে আদহাম রাহ: বলেন, আমি বাদশাহী ছেড়ে দরবেশি জীবন গ্রহণ করেছি। এই জীবনে যে শান্তিতে আছি, বাদশাহরা যদি জানত তবে তা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের সাথে যুদ্ধ করত। তাকওয়াবান হয়ে গেলে দরবেশ হয়ে যেতে হয় না। তার জীবনটা কুরআন হাদিসের হিসাবে চালাতে হয়। মেপে মেপে চলতে হয়। মেপে মেপে বলতে হয়। মেপে মেপে ভোগ করতে হয়। দুনিয়া নিয়ে তাকে বেপরোয়া হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে শুধু সফলতা আর সফলতা। এই সফলতাগুলো থেকে কিছু সফলতা কুরআনের আলোকে তুলে ধরা হয়েছে-
১. অবারিত রহমত লাভ : মুমিন মাত্রই রহমতের প্রত্যাশী। রহমত কে না চায়! মুমিন বান্দা মহান রবের নির্দেশ মেনে চলে তারপরও তার মধ্যে মাওলার ভয় কাজ করে সাথে রহমতেরও আশা করে। এই ভয় ও আশা তার মধ্যে এক অনাবিল শান্তি এনে দেয়। সে মহান মালিকের আশ্রয়ে চলে যায়। অপর দিকে পাপী সে পাপ করে সাথে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। এই ভাবনা তাকে সব সময় অস্থিরতার মধ্যে ফেলে রাখে। মহান রব কত সুন্দর করে আমাদের সূরা আরাফের ৯৬ নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আর যদি গ্রামবাসী ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সব বরকত উন্মোচন করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে ফলে আমি তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছি।’
২. সহজেই হক বুঝতে পারে এবং গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় : দুনিয়ায় চলতে গেলে প্রতিটি মানুষের সামনে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সফলতা-ব্যর্থতা, কল্যাণ-অকল্যাণ, লাভ-ক্ষতি, পুরস্কার-তিরস্কার ইত্যাদির মুখোমুখি হতে হবে। একজন মুত্তাকিকে মহান রব অনায়াসে সত্য ন্যায় কল্যাণ সফলতা বেছে নেয়ার তৌফিক দান করবেন তার সব অপরাধ মার্জনা করে দেবেন। এর চেয়ে আর বড় সফলতা আর কী থাকতে পারে। মহান রব সূরা আনফালের ২৯ নং আয়াতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা যদি তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করো, তাহলে মহান রব তোমাদেরকে হক ও বাতিলের মানদ- দান করবেন। তোমাদের সব দোষত্রুটি তোমাদের থেকে দূর করে দেবেন। তোমাদের যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। প্রকৃতপক্ষে মহান রবই বড় অনুগ্রহশীল।’
৩. মুমিন দুনিয়া আখিরাতে সবসময় ভয় দুঃখ পেরেশানিমুক্ত : ভয় পেরেশানি দুঃখ শান্তির অন্তরায়। একজন মুমিন সব সময় নিরুদ্বেগ ও শান্তিতে থাকে তাকে কখনো ভয় কাবু করতে পারে না। বিপদেও সে ঘাবড়িয়ে যায় না। বিপদকে সে সফলতার মঞ্জিল মনে করে। মহান রব তার বন্ধু, সাহায্যকারী জানে। সব কাজে সবখানে তাদের সফলতা আর সুসংবাদ। মহান রব সূরা ইউনুসের ৬২-৬৪ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কোনো ভয় নেই ও দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। তাদের জন্য পৃথিবীর জীবন ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহর কথায় কোনো নড়চড় হয় না। এটিই মহা সাফল্য। ৪. রিজিকের পেরেশানি দূর : দুনিয়ার আমরা রিজিকের জন্যই বেশি পেরেশানি করে থাকি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মে ব্যস্ত থাকি। এমনকি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে থাকি শুধু এই রিজিকের জন্য। মহান রব তাকওয়াবানকে অবারিত রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। তার কোনো সঙ্কটই থাকবে না। মহান রব সূরা তালাকের ২-৩ নং আয়াতে বলেন, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ ভয় করে চলে (তাকওয়া অবলম্বন করে) তিনি তার জন্য সঙ্কট থেকে বের হওয়ার পথ করে দেবেন। আর আল্লাহ তায়ালা এমন জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন যার ধারণাও সে করে না।
৫. শত্রুর শত্রুতা থেকে হিফাজত : দুনিয়ায় চলতে গিয়ে দ্বীনি ও দুনিয়ার অনেক কারণে অন্যের সাথে শত্রুতা তৈরি হতে পারে। অনেক সময় আপনার উন্নতি দেখে কেউ কেউ শত্রুতা শুরু করে। এই শত্রুর শত্রুতা বা ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য গ্যারান্টিও তাকওয়া। মহান রব বলেন, ‘তোমাদের সুদিনে তাদের খারাপ লাগে। তোমাদের দুর্দিনে তারা বেজায় খুশি। কিন্তু যদি তোমাদের সবর ও তাকওয়া থাকে তাহলে তাদের কোনো ফন্দিবাজি (শত্রুতা) তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাদের সব কাজকর্ম মহান আল্লাহর আয়ত্তে’ (সূরা আলে ইমরান-১২০)। ৬. সব কাজ সহজ হয়ে যায় : আমরা যত দিন দুনিয়াতে থাকি আমাদের বিভিন্ন কাজ করতেই হবে। সব কাজ যদি করতে গিয়ে দেখি খুবই সহজ এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটি শেষ করে ফেলা যায় তবে কতই না মধুর হয়। মহান রব সূরা তালাকের ৪ নং আয়াতে বলেন, ‘যে আল্লøাহকে ভয় করে (তাকওয়া অবলম্বন) করে, আল্লাহ তায়ালা তার কাজ সহজ করে দেন।’
৭. শয়তানের আক্রমণে কান খাড়া হয়ে যায় : আমরা চলতি পথে কোনো বিপদ সঙ্কেত পেলে সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যাই। শয়তান আমাদের প্রকাশ্য দুশমন। সে বিভিন্নভাবে আমাদের কুমন্ত্রণা দেয়। যারা মুক্তাকি শয়তান যে পথেই তাদের আক্রমণ করুক না কেন তারা খুব সহজেই বুঝতে পারে। সতর্ক হয়ে যায়। হামলা প্রতিহত করে। মহান রব সূরা আরাফের ২০১ নং আয়াতে বলেন, ‘মুত্তাকিদের কাছে শয়তানের পক্ষ থেকে যখন কোনো কুমন্ত্রণা আসে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে তখন তারা সত্য দেখতে পায়।’ ৮. সব কাজে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হয় : মহান রবের দয়া ছাড়া কারো পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সৃষ্টি হিসেবে সবাইকে মহান আল্লাহ দয়া করেন। অন্য দিকে মুমিন মাত্রই আল্লাহর সাহায্যপ্রত্যাশী। প্রতিদিন অনেকবার মাওলার সাহায্য কামনা করে একজন মুমিন, মুত্তাকি। মহান রব সূরা নাহলের ১২৮ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্ম সম্পাদনকারী।’
৯. আল্লাহর কাছে সম্মান মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া : দুনিয়ার মানুষের কাছে সম্মানের মাপকাঠি অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, সৌন্দর্য, শিক্ষা, পদবি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে সম্মানের, সম্মান বৃদ্ধির একমাত্র মাপকাঠি তাকওয়া। মহান রব বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান ওই ব্যক্তি যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে তাকওয়াবান’ (সূরা হুজরাত-১৩)। ১০. তাকওয়ায় পাপ মুক্ত হয়ে যায় : সব মুমিন চায় তার পাপ না থাকুক। মহান রব যেন তার সব পাপ মাফ করে দেন। হ্যাঁ, তাকওয়া এমন গুণ যা অর্জন করতে পারলে মহান রব গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা তালাকের ৫ নং আয়াতে বলেন, ‘যে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় (তাকওয়া অবলম্বন) করে, আল্লাহ তায়ালা তার পাপসমূহ পরিবর্তন করে দেবেন এবং (শুধু তাই নয়) তাকে বড় পুরস্কার দেবেন।’
১১. তাকওয়া অবলম্বনকারীর জ্ঞান বৃদ্ধি পায় : জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানে পায় সেখান থেকে কুড়িয়ে নেয়। তাকওয়াবানকে মহান রব তার রহমতেই জ্ঞান বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো। তিনি তোমাদের শিক্ষা দেন এবং তিনি সব কিছু ভালোভাবেই জানেন’ (সূরা বাকারা-২৮২)।
১২. মুত্তাকিরাই আল্লাহর ভালোবাসা পায়, আল্লাহই তাদের অভিভাবক, বন্ধু : আল্লাহর ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান আর কোনো কিছু নেই। মহান রবের ভালোবাসার কাছে সব কিছু তুচ্ছ। মহান রবের ভালোবাসা পেয়ে গেলে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকওয়া অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা তাওবা-৭)। ১৩. তাকওয়া ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না : বান্দা যতই ইবাদত করুক, যদি তাতে তাকওয়া না থাকে সবই ব্যর্থ, নিষ্ফল। ইবাদত কম বা বেশি হোক যদি তাকওয়া না থাকে তা কবুল হয় না। মহান রব সূরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শুধু মুত্তাকিদের পক্ষ থেকেই কোরবানি কবুল করে থাকেন।’
১৪. সফলতার মূল চাবিকাঠি তাকওয়া : প্রত্যেক মানুষ সফলতা চায়। অন্যদের সফলতা ক্ষণিকের। মুমিন চায় সর্বোচ্চ ও চির সফলতা। এই সফলতার চাবিকাঠি হলো তাকওয়া। মহান রব সূরা আলে ইমরানের ১৩০ নং আয়াতে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেন সফলকাম হতে পারো’। সূরা তোয়াহার ১৩২ নং আয়াতে বলেন, ‘শুভ পরিণাম শুধু মোত্তাকিদের জন্য’। সূরা আরাফের ১২৮ নং আয়াতে বলেন, ‘শুভ পরিণাম তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য’।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com