সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ অপরাহ্ন

শ্রীমঙ্গলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়

এহসান বিন মুজাহির (শ্রীমঙ্গল) মৌলভীবাজার :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের দুর্গম পাহাড়ি জনপদে অবস্থিত মোহাজেরাবাদ গ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য এ গ্রামের কিছু নিবেদিত প্রাণ মানুষেরা ১৯৯০ সালে মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবল বাধা উপেক্ষা ও সংগ্রাম করে ৩২ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়টি আজ ওই এলাকাকে আলোকিত করে তুলেছে। বর্তমানে ৪৬৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয়টি। মোহাজেরাবাদ গ্রামটি এক সময় ছিল অজপাড়াগাঁ। গ্রামটির চারপাশে চা, আনারস, লেবু বাগান এবং উচুঁ-নিচু টিলায় বেষ্টিত। গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাকাঁ পিচঢালা পথ। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে দূর্গম পাহাড়ি জনপদে ওই বিদ্যালয়টির অবস্থান। ভাঙা বেড়া, দরজা জানালার জরাজীর্ণ অবস্থা আর টিনের ছাউনি বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ঘর দিয়ে মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন মোহাজেরাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়া, দরজা জানালার জরাজীর্ণ টিনের ছাউনি বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ঘরের সেই বিদ্যালয়টি আজ চারতলা বিশিষ্ট বিশাল একাডেমিক রূপান্তরিত হয়েছে। বিদ্যালয়ের সীমানায় বাউন্ডারি ওয়াল, গেইট, বিদ্যালয়ের সামনে বিশাল মাঠ, একাডেমিক ভবনে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্লাস রুম, বিশাল অফিস রুম, শিক্ষক মিলনায়তন রুম, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব রুম, বিজ্ঞানাগার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ও মুক্তিযোদ্ধা কর্নার রুম, ছাত্র, ছাত্রী এবং শিক্ষকদের জন্য পৃথক পৃথক ওয়াশরুম, আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থাসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল হাছান বলেন, আমি ২০০০ সালে এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। তখন বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। ছিল না বিদ্যালয়ের নামে কোনো নিজস্ব ভূমি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্রামের সকলের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের ভূমির ব্যবস্থা করি। এরপর বিদ্যালয়ের নামে জরিপ সংক্রান্ত কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়। গত ০১/১০/২০০০ খ্রিস্টাব্দ তারিখে সিলেট ডিডি অফিসে বিদ্যালয় খোলার অনুমতির জন্য আবেদন করি। আবেদনের প্রেক্ষাপটে সিলেট ডিডি ড. সৈয়দ আহম্মদ ০১/০১/২০০০ সাল থেকে ৩ বছরের জন্য ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অর্থাৎ নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিদ্যালয়টি এতই জরাজীর্ণ ছিল যে, ক্লাশের জন্য কোনো কক্ষ উপযুক্ত ছিল না। তখন মোহাজেরাবাদ গ্রামের গন্যমান্য ব্যাক্তি নিয়ে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এর সাবেক চীফ হুইপ বীর মুক্তি যোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ডঃ মোঃ আব্দুস শহীদ এমপি মহোদয় এর সাথে ঢাকায় দেখা করি এবং ২ লক্ষ টাকা জেলা পরিষদ থেকে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। ফলে উত্তর দিকে ৬০ ফুট লম্বা আধা পাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে আরও তিনবার বরাদ্দ করা হয়। এই ঘর ছাউনির জন্য হোসানাবাদ মালিক পক্ষ থেকে গাছ সংগ্রহ করে ২৫০ ফুট কাঠ করা হয়। তারপর বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি, ৬নং আশীদ্রোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মামুন অর রশীদ কর্তৃক ঘরটির জন্য পরিষদ থেকে দরজা, জানালা ও মেঝ পাকা করা হয়। বিদ্যালয়ের জন্য মরহুম মামুন অর রশিদ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। অনুমতির শেষ হওয়ার পর ২০০৩ সালে বিদ্যালয়টি ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত স্বীকৃতির জন্য আবেদন করি। আবেদনের সার্বিক যোগাযোগের প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে পাঁচ বছরের জন্য স্বীকৃতি লাভ করে। ২০০৩ সালের ১৭ই নভেম্বর বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির জন্য মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ নবম শ্রেণিতে দু’টি শাখায় ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অনুমতি প্রদান করেন। বিদ্যালয়টি ৮ম শ্রেণ পর্যন্ত স্বীকৃত পাওয়ার পর বিদ্যালয়টি কে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিওভূক্তি করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেছি। তার কিছুদিন পর আমার সহকর্মী দেলোয়ার হোসেন এর সাথে আলাপচারিতা করে তাহার ছোটো ভাই এডভোকেট মাইনুদ্দিন মজুমদার এর সহযোগিতায় তৎকালীন মৌলভীবাজারের এমপি নাসের রহমান এর সুপারিশক্রমে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের মাধ্যমে ২০০৪ সালে মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে একমাত্র মোহাজেরাবাদ নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এমপিওভূক্ত করা হয়। ২০০৫ সালের ১লা জানুয়ারি হতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি লাভ করে। ২০০৬ সালে প্রথম বারের মতো মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সর্বমোট ৯ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কওে ৬ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। বিদ্যালয়ের ১ বছরের ফলাফল দিয়েই মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ২০০৭ সালে মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর বিদ্যালয়টির মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিও এবং নতুন ভবনের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করি। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ আসনের এমপি উপাধক্ষ্য ডঃ মোঃ আব্দুস শহীদ এমপি মহোদয় এর মাধ্যমে ২০১০ সালে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভূক্তি হয় এবং ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে একতলা ভবন নির্মাণ হয়। ভবন নির্মাণের জন্য সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। একতলা ভবনের টাকার পরিমাণ ছিল ৫৭ লক্ষ ঊনষাট হাজার সাত শত ছিয়ানব্বই টাকা। বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান মনস্ক, সৃজনশীল, মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার পক্ষে এবং এলাকাবাসীর সন্তানদের চাহিদার কারণে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খোলার আবেদন করা হলে ২০১৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তিসহ পাঠদানের অনুমতি লাভ করে। বর্তমানে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২৭টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনটি বিভাগই বিদ্যমান রয়েছে। বিদ্যালয়টি বর্তমানে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাওয়ার কারণে আব্দুস শহীদ এমপি মহোদয় এক সভায় বিদ্যালয়টি চারতলা ভবন নির্মানের ঘোষণা করেন এবং চারতলা ভবনের জন্য সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে শিক্ষা প্রকৌশল কর্তৃক ভবন নির্মাণ করা হয়। চারতলা ভবনের টাকার পরিমাণ ছিল ১ কোটি সাতচল্লিশ লক্ষ একানব্বই হাজার পাঁচ শত আশি টাকা ৭৫ পয়সা মাত্র। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রনালয় কর্তৃক ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিদ্যালয়ের বাউন্ডারি করা হয়। শিক্ষার্থীর যুগোপযোগি শিক্ষার জন্য শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনে গত ১৮/০৪/২০১৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে আবেদন করি এবং শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এলাকার এমপি মহোদয়ের নিকট আবেদন করি। এমপি মহোদয়ের সহযোগিতায় ২০২১ সালে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ল্যাবে ল্যাপটপ ১৭টি রয়েছে এবং এর কার্যক্রম চলমান। শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব রণধীর কুমার দেব এবং বর্তমানে ৬ নং আশিদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব রণেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন (জহর) বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সার্বিক সহযোগিতা করেন। তারঁ মাধ্যমে বিদ্যালয়ের গেইট নির্মান করা হয়। বিদ্যালয়ের অনুমতি থেকে এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন মামুন অর রশীদ, মোঃ চেরাগ মিয়া, মোঃ শাহাদত হোসেন, মোঃ চেরাগ মিয়া, মোঃ আবু ছাইদ, সেলিম আহমদ, মোঃ আমিনুল ইসলাম এবং বর্তমানে মোঃ আবু ছাইদ। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের বেগম রাসুলজান আব্দুল বারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে ফলাফল অর্জন করে। স্কুলের একাডেমিক স্বীকৃতি ও পাঠদান অনুমতি পাওয়ার পর থেকে স্কুলের নিজস্ব নামে এ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সন্তোষজনক ফলাফল অর্জন করে আসছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল হাছান বলেন-স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরুতেই আমি গুরুত্ব দেই বিদ্যালয়ের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পড়া-লেখার মানোন্নয়নের দিকে। আর এতে সাফল্যও এসেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে। এ স্কুল থেকে পড়াশোনা করে বহু ছাত্র-ছাত্রীরা বর্তমানে দেশে-বিদেশে যেমন সুনাম অর্জন করেছেন, তেমনি বিভিন্ন পেশায় সমাজের উঁচু স্থানে অবস্থান করছেন। এলাকায় শিক্ষা বান্ধব ও মানসম্মত স্কুল হিসেবে মানুষের এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দৃষ্টি এ স্কুলের দিকে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলায় জিপিএ-ফাইভসহ সন্তোষজনক পাশ হওয়ার গৌরব অব্যাহত রেখে চলেছে। তিনি আরও বলেন, আমি দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ শিক্ষকতা মহান পেশায় নিজকে জড়িয়ে শিক্ষার আলো বিলিয়েছি। ২৩ বছর যাবৎ মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমি আমার কর্ম দক্ষতা, মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বহু সম্মাননা ও পুরষ্কার পেয়েছি। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯-এ প্রতিযোগিতায় সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছি। আমার এই কৃতিত্বের জন্য বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী, এলাকাবাসী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা স্মারক ও পুরষ্কার প্রাপ্ত হই। আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে চেষ্টা করেছি এবং এখনও প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি অজপাড়া গাঁয়ের মোহাজেরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়টিকে একটি আদর্শ বিদ্যালয় হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য। আমি বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মানোন্নয়ন বৃদ্ধিসহ সার্বিক উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। স্থানীয় এমপি আলহাজ্ব উপাধ্যক্ষ ড. মোঃ আব্দুস শহীদ এমপি, স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবকসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি এপর্যায়ে এসেছে। এজন্য বিদ্যলয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল হাছান সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com