ইতিহাসগ্রন্থ মারফত কিশোর বয়স থেকেই ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইয়ের নাম আমরা অনেকে জানি। কিন্তু রানীর রূপ ধারণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া এক বীরাঙ্গনার নাম এতকাল আড়ালেই পড়ে ছিল। কারণ ইতিহাসের কাহিনী নিয়ে বিপুল আকৃতির গ্রন্থ যারা রচনা করেছেন তারা তাকে দলিত সমাজের প্রতিনিধি বলে সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। এমন হীন অনুদার মানসিকতার শিকার হলে কী হবে, তার সমাজের লোকেরা কিন্তু তাকে ভুলে যায়নি। তাই তিনি স্থান করে নিয়েছেন লোককাহিনীতে, লোকস্মৃতিতে তথা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী এ বীর রমণীর নাম ঝলকারি বাই। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ঝলকারি বাই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বাজি রাখেন। তিনি রানী লক্ষ্মীবাইয়ের নিয়মিত সেনাদলের একজন সদস্য ছিলেন। নারী সৈন্যদের নিয়ে রানী একটি বাহিনী গঠন করেছিলেন। স্বীয় রণকৌশল ও অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ হওয়ায় ‘দুর্গা দল’ নামের সে বাহিনীর প্রধান ছিলেন ঝলকারি। তার শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করে ভারতের রাষ্ট্রকবি আখ্যাপ্রাপ্ত কবি মৈথিলীশরণ গুপ্ত নিচের কয়েকটি পঙিক্ত রচনা করেন জাকর রণ মেঁ ললকারী থী।/ওহ তো ঝাঁসী কী ঝলকারী থী॥/গৌরোঁ সে লড়না সিখা গঈ।/রানী বন জওহর দিখা গঈ॥/হ্যায় ইতিহাস মেঁ ঝলক রহী।
ওহ ভারত কী হী নারী থী॥১ (রণাঙ্গণে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিল ঝাঁসির ঝলকারি বাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা শিখিয়েছে। রানি হয়ে জৌহর২ দেখিয়ে গেছে সে। ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত তৈরি হলো। সে তো ছিল ভারতেরই নারী।)
মৈথিলীশরণ গুপ্ত ব্যতীত আরো অনেকেই তাকে নিয়ে পদ্য রচনায় মনোযোগী হন। চোখেলাল বর্মা নামের একজন হিন্দি কবি তার ওপর বৃহৎ একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। চার খ-ে লিখিত ‘ভারতের দলিত আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থের রচয়িতা মোহনদাস নৈমিশরায় ‘বীরাঙ্গনা ঝলকারী বাঈ’ শিরোনামে হিন্দিতে একটি উপন্যাস রচনা করেন। অবশ্য তাকে নিয়ে লেখার প্রতি লেখকরা হয়তো এতটা মনোযোগী হতেন না যদি হিন্দি সাহিত্যিক বৃন্দাবনলাল বর্মার রচিত ‘ঝাঁসী কী রানীÍলক্ষ্মীবাঈ’-এর মতো ঐতিহাসিক একটি উপন্যাসে তার চরিত্রটি স্বমহিমায় প্রাঞ্জল হয়ে না উঠত। কিন্তু কে ছিলেন এ ঝলকারি বাই? ঝাঁসির রানীকে নিয়ে উপন্যাসে কেন তিনি এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন? কেন দলিত সমাজের প্রতিনিধি হয়েও গ্রন্থপ্রণেতারা তাকে অস্বীকার করতে পারছেন না? উত্তর হলো, ঝলকারি বাই হলেন উপমহাদেশের এমন এক বীর রমণী যিনি ঝাঁসির রানীর রূপ ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক বর্মার লিখিত উপন্যাসে আমরা সে চিত্রটি মনোরম বর্ণনায় উপস্থাপিত পাইÍ ঝলকারি নিজেই নিজেকে সাজাল। সেরা কাপড় পরল সে। ঠিক যেভাবে লক্ষ্মীবাই পরতেন। গলায় পরার জন্য কণ্ঠহার ছিল না তার। তবে কাচের পুঁতির একটা মালা ছিল। সেটা গলায় পরল। সূর্য ওঠার বেশ আগে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে প্রস্তুত হলো সে।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার ওপর উঠে বসে দ্রুতবেগে ইংরেজ শিবিরের দিকে রওনা হলো। সঙ্গে কোনো অস্ত্র নিল না সে। চোলির ভেতরে কেবল একটি ছুরি নিল।
একটু দূরেই শ্বেতাঙ্গদের প্রহরা ছিল। তাকে আটকে দেয়া হলো।
পথ আগলে দেয়ায় ঝলকারি বলল, ‘তোমাদের জাড্যালের৩ কাছে যাচ্ছি আমি।’
যদি কোনো হিন্দুস্তানি তার এ ভাষা শুনত তাহলে সে না হেসে পারত না।
এক গোরা সৈন্য কিছুটা হিন্দি জানত। সে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি?’ ‘রানী ঝাঁসির রানী, লক্ষ্মীবাই।’ঝলকারি ধমকের স্বরে বলে উঠল। গোরা সৈন্যটি তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সৈন্যরা তখনই নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করল, ‘একে অবিলম্বে জেনারেল রোজের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।’ তাকে ঘিরে ধরে গোরা সৈন্যরা শিবিরের ভেতরে চলল। সমস্ত শহরের গোরাদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল এই বলে যে ঝাঁসির রানীকে তারা ধরে ফেলেছে। খুশিতে তারা পাগলপারা। খুশিতে ঝলকারি নিজেই তখন তাদের থেকে বেশি পাগল হয়ে গেল।
তার বিশ্বাস ছিল, ইংরেজরা তার বিচার-তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর এর ফাঁকে রানী অনেক দূরে চলে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবেন।৪
আজ থেকে প্রায় ১৯২ বছর আগে ঝাঁসি থেকে চার ক্রোশ দূরে অবস্থিত এক ছোটো গ্রামের একটি গরিব পরিবারে তার জন্ম হয়। অল্প বয়সে তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা সদোবর সিং তাকে পুত্রতুল্য লালনপালন করেন এবং যুদ্ধকলা, হস্তীসওয়ারি, অস্ত্রচালনা প্রভৃতি শিক্ষা দেন। যে রকম পারিবারিক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্তি ছিল অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু নিজেকে তিনি অনন্য সাহসী, নির্ভীক ও দূরদর্শীরূপে প্রস্তুত করেন। তিনি এমন এক নারী বনে যান যার বাহাদুরি ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজে স্থান না পেলেও সাধারণ জনতার হূদয়ে ঠিকই স্থান পেয়েছে। গল্প-কাহিনী-উপন্যাস-কবিতার আকারে তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান রয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও তার গল্প দলিত ও প্রান্তিক সমাজের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। তাই গোয়ালিয়রসহ ভারতের কয়েকটি শহরে অশ্বারোহী ঝলকারি বাইয়ের মূর্তি আজও চোখে পড়ে।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কথা যখন যেখানে স্মরিত হয় ঝলকারির প্রসঙ্গ সেখানে আসবেই। কথিত আছে যে ইনি ঝাঁসির রানীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ইতিহাসের যেসব পুস্তক রচিত হয়েছে সেগুলোয় সমাজের অধঃপতিত ও দলিত অন্ত্যজ সমাজের চিত্র একেবারেই অনুপস্থিত। তার সম্পর্কে যে গল্পটা হরহামেশা শোনা যায় তা এমনÍঝাঁসির সন্নিকটে ভোজলা নামে একটা গ্রাম আছে যেখানে ঝলকারির জন্ম বলে সবাই ধারণা করে। ওই গ্রামের লোকেরা বলে, ঝলকারি বাই এ গ্রামের মেয়ে এবং তার পরিবার পেশায় ছিল গরিব তাঁতি। সুতরাং গরিব পরিবারের শিশুরা যেভাবে লালিত-পালিত হয় তিনিও সেভাবেই বড় হয়েছেন। তাকে নিয়ে অনেক সাহসী গল্প লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। অনেক গানও রচিত হয়েছে তাকে নিয়ে। কথিত আছে, অল্প বয়সে তিনি একবার একটি ব্যাঘ্র হত্যা করেছিলেন; গ্রামের যেখানে দস্যুদের উৎপাত হতো সেখানে তড়িৎগতিতে এসে তাদের তাড়িয়ে দিতেন তিনি। উত্তর ভারতে অবস্থিত বুন্দেলখ-ের লোকস্মৃতিতে তাকে বীরাঙ্গনারূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। সেখানকার জনগণ মনে করে, শৈশব থেকেই এ নারী বীরোচিত ছিলেন। পূরণ নামের এক সাহসী মল্লযোদ্ধা ছিল তার স্বামী। ঝাঁসির রানীর শিবিরে সৈনিক হিসেবে সে কাজ করত এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে সে শাহাদতবরণ করে। হয়তো এ ঘটনাই তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝলকারি বাইয়ের মতো এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিল।
কিংবদন্তি অনুসারে, ঝলকারি বাই প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে শাহিমহলে যেতেন এবং শুরুতে সেখানে চাকরানি হিসেবে কাজ করতেন। রানী লক্ষ্মীবাই যখন তার সম্পর্কে সম্যক অবগত হলেন তখন তারা দুজনে সহেলি বনে গেলেন। অনেকে বলেন, তাদের দুজন দেখতে একই রকম ছিলেন। অস্ত্রচালনায় দক্ষ ছিলেন বলে দুর্গা দল নামে রানীর নারী সেনাদলে তার অভিষেক ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের নিধনের পর ইংরেজরা তার স্থলাভিষিক্তকে স্বীকার করেনি। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধের কারণে রানী লক্ষ্মীবাই শাসন ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে অদূরভবিষ্যতে তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এমনটা ভেবে প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ চারপাশে ছড়াতে শুরু করল। উত্তর ও মধ্য ভারতে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। সিপাহিরা লক্ষ্মীবাইয়ের সমর্থনে একত্র হতে শুরু করল। ১৮৫৮ সালে যখন জেনারেল স্যার হিউ রোজ কামান নিয়ে ঝাঁসির রানীর ওপর হামলা করল এবং চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ফেলল তখন ঝলকারি ও তার স্বামী সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করলেন। রানীকে প্রাসাদ ছেড়ে নিরাপদে চলে যেতে তিনি পরামর্শ দিলেন এবং নিজে যুদ্ধে অধিক নিবিষ্ট হলেন। রানীর বেশ ধারণ করে কামানের সামনে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করায় ইংরেজ সৈন্যরা ধাঁধায় পড়ে গেল। তার এ চাল দীর্ঘ সময়ের জন্য ইংরেজ সৈন্যরা বুঝতেই পারেনি। এবং এর ফাঁকে রানী যুদ্ধস্থল ত্যাগ করে চলে যেতে সক্ষম হন। এর মধ্যে স্বামী পূরণ কোলি ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করার সময়ে মৃত্যুবরণ করে। স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে ঝলকারি বাই হিংস্র বাঘিনীর রূপ ধারণ করেন এবং বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। যখন ঝলকারি বাই লক্ষ্মীবাইয়ের রূপ ধারণ করে ইংরেজ জেনারেল রোজের সম্মুখে উপস্থিত হলেন তখন জেনারেলের চক্ষু চড়কগাছ। এমন মুহূর্তের কথা বৃন্দাবনলাল দাস তার উপন্যাসে এভাবে বর্ণনা করেছেন-ঝলকারি রোজের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। সে ঘোড়া থেকে নামল না। রানীর যেমন শান তেমন অভিমান, তেমনি হুংকার। অল্প সময়ের জন্য জেনারেল রোজও ধোঁকা খেয়ে গেলেন।…
শিবিরে রাব দুলহাজু ছিল। খবর পেয়ে সে তৎক্ষণাৎ এসে হাজির হলো এবং তাকে অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করল।
রোজের কাছে এসে দুলহাজু বলল, ‘এ তো রানী নয়, জেনারেল সাহেব। এ তো ঝলকারি কোরিন। রানী এভাবে সম্মুখে আসতে পারেন না।’৫
এ গল্প বুন্দেলখ-ের লোকের মুখে মুখে ফেরে। আর এভাবে তিনি অমর শহীদরূপে ইতিহাসে জীবিত থেকে গেছেন। তার মৃত্যুর পরে অনেক প্রজন্ম অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে নয়, বরং সাধারণ মানুষের মনে আরো বেশি ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। লিখিতরূপে সর্বাগ্রে ‘মাঝা প্রবাস’-এ ঝলকারি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। মারাঠি ভাষায় রচিত গ্রন্থটি একটি সফরনামা, যেটি বিষ্ণুভাটজি গোডসে না¤œী একজন লেখক ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রাক্কালে পদব্রজে ভারতবর্ষ বিচরণ করে রচনা করেন। তারপর বৃন্দাবনলাল বর্মার উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় তিনি উঠে আসেন। এছাড়া ভবানী শংকর বিশারদ, মাতা প্রসাদ, ডিসি দিনকর, মোহনদাস নৈমিশরায় প্রভৃতি লেখকের রচনায় তাকে আমরা উপস্থিত দেখতে পাই। লেখক বদ্রীনারায়ণের মতে, ‘দলিত লোকেরাই কেবল তার ওপর ৪০টিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার অর্থ হলো, লোকেদের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন, এখনো আছেন। সুতরাং ইতিহাসে তিনি নেই এ কথা বলা যায় না।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেখানে আশপাশের ছোট-বড় অনেক রাজা এ যুদ্ধে ঝাঁসির রানীর হাতে হাত রাখেননি সেখানে অন্ত্যজ বলে যাদের মনে করা হয় তারা কেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ঝাঁসির রানীর সঙ্গে একাত্ম হলেন বা কীভাবে হলেন? রানীই-বা এ কাজ কীভাবে করলেন, কেন করলেন? ঔপন্যাসিক মোহনদাস নৈমিশরায় লক্ষ্মীবাইয়ের ব্যাপারে বলেন, ‘রানী যে কাজটা এখানে করেছেন এটা ইতিহাসে বোধ হয় সর্বপ্রথম ঘটেছে। অর্থাৎ অন্ত্যজ বা দলিত সমাজের লোকেদের নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করার কাজটি।’ অবশ্য এর একপ্রকার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বদ্রীনারায়ণ করেছেন। তার বক্তব্য হলো, ‘এমন রাজা-রাজ্ঞীদের অন্দরমহলে আশপাশে বসবাসরত বিচিত্র পেশার লোকেরা কাজ করতে আসত। তারা বিভিন্ন ঘরোয়া কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকত। ঝলকারি বাইও যেহেতু এমন একটি পেশার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, তিনিও রানীর অন্দরমহলে কাজ করতেন। যারা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগও ছিল। কথিত আছে, তিনি রানীর দাসী ছিলেন। তখন রানীর বয়সও সামান্য ছিল। তার দাসীদেরও বয়স কম ছিল। কম বয়সী হওয়ায় তাদের সঙ্গে রানীর সদ্ভাব হওয়াই স্বাভাবিক। কথিত আছে, তার মুখের গড়নও দেখতে হুবহু লক্ষ্মীবাইয়ের মতো ছিল।’ রানীর সঙ্গে ঝলকারি বাইয়ের যোগাযোগের কারণ হিসেবে বদ্রীনারায়ণ দুটো বিষয়ের কথা বলেন। এক. সেবাকার্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার বিষয়টি এবং দুই. তার স্বামীর রানীর সিপাহিশালায় নিয়োজিত থাকার বিষয়টি।
সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থার সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে লক্ষ্মীবাইয়ের চিন্তাধারা বেশ ভিন্ন ছিল। এরই কিছুটা আভাস পাওয়া যায় বৃন্দাবনলাল বর্মার উপন্যাসে। উপন্যাসে রানী ও ঝলকারির প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটি বর্ণনা করার সময়ে লেখক লিখেছেন, ‘কেল্লার অভ্যন্তরে সব জাতির লোকজন যেতে পারে। কেল্লার যে পাশে মহাদেব ও গণেশের মন্দির আছে সে পাশকে শংকর কেল্লা বলে। সবাই সে দকে যেতে পারে। চামার, বাসর, ভাঙ্গী প্রভৃতি অচ্ছুত বলে পরিচিত জাতির লোকেরা সেখানে যেতে পারে।’৬
সুতরাং লক্ষ্মীবাই যথেষ্ট জনমুখী রানী ছিলেন। তাই তার সঙ্গে ঝলকারি বাইয়ের দেখা হওয়ার বিষয়টা একেবারে হেসে উড়িয়েও দেয়া যায় না। হয়তো এজন্যই বৃন্দাবনলাল বর্মার উপন্যাসের এক স্থানে রানী লক্ষ্মীবাইকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের দেশে উঁচু-নিচু ভেদ যদি না থাকত তাহলে কত ভালো হতো।’ নিজের ইচ্ছার কথাও রানী তখন বলে বসেন, ‘আমার ইচ্ছা, সব জাতির লোকেদের থেকে নির্বাচন করে কিছু লোককে তোপ-বন্দুক চালানো শেখানো হোক।’
আরেক ঔপন্যাসিক মোহনদাস নৈমিশরায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝলকারি বাইয়ের যুদ্ধ করার কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে লেখেন, ‘ঝলকারি বাইয়ের চরিত্র ধীরে ধীরে এমন সুদৃঢ় হতে লাগল যে তিনি স্বদেশ সম্পর্কে ভাবতে শুরু করলেন। সমাজ সম্পর্কে ভাবতে শুরু করলেন। আমি তো আগেই লিখেছি যে লক্ষ্মীবাইয়ের বিষয়টা বোঝা যায়…তিনি স্বীয় রাজ্য নিয়ে ভাববেন সেটাই স্বাভাবিক।… কিন্তু ঝলকারি বাইয়ের বিষয়টা আমার বোধগম্য হয় না।… তার তো কিছুই ছিল না নিজের। তার পরও তিনি নিজের সমাজ সম্পর্কে ভাবতেন। এ ভাবনা অসামান্য বটে।’
তাহলে ঝলকারি নামে সত্যি সত্যিই একজন ছিলেন? আরেকজন লেখক রাজকুমার ইতিহাসকার বলেন, তিনি ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইয়ের কেল্লার সম্মুখেই থাকতেন; ভোজলা গ্রামেই তার জন্ম; পাহাড় ও বনে গিয়ে এ গ্রামের লোকেরা কাঠ কুড়াত; কেল্লার দক্ষিণে ছিল উন্নাব ফটক। ঝলকারি বাইয়ের ঘরের লোকেরা সেখানেই থাকত।
ঔপন্যাসিক-কবি-নাট্যকারদের রচনায় এভাবে সরব থাকলেও ইতিহাসগ্রন্থে আজও অনুপস্থিত ঝলকারি। একে তো তিনি ছিলেন অন্ত্যজ সমাজের, সঙ্গে নারীও তিনি। এভাবে দুই সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। ‘বীরাঙ্গনা ঝলকারী বাঈ’ নামক উপন্যাসের রচয়িতা মোহনদাস নৈমিশরায় অবশ্য ভিন্ন কথা বলেন। তার মতে, ‘ইংরেজ আমলে রচিত গ্যাজেটিয়ারগুলোতে সাধারণ কোনো লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত হতো না। তখন ঝলকারি বাই তো ছিলেন সাধারণ এক মহিলা। পরেই না তিনি অসাধারণ হলেন। গ্যাজেটিয়ারে নাম লেখাতে তো অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। কাকে লোকে স্মরণে রাখবে, কাকে রাখবে না তা তো সামাজিক অসমতার সঙ্গে সংযুক্ত।’ তার মতে, ‘ঝলকারি বাইয়ের সময়ে এ দেশে দলিত লোকেদের সম্মান করার কোনো রীতি ছিল না। ইংরেজরাও এ বিষয়ে অবগত ছিল। দেশী লোকেরা যাকে সম্মান দিত ইংরেজরাও তাকে সম্মান দিত।’ অর্থাৎ সামাজিক কারণেই ইংরেজদের দলিল-দস্তাবেজে এ মহীয়সী রমণীর নাম নেই।বৃন্দাবনলাল বর্মা আরো লেখেন, ‘উন্নাব ফটকের ওপরে কোরিদের তোপ ছিলÍএটা ঐতিহাসিক সত্য। সে তোপখানার সঞ্চালক ছিলেন পূরণ কোরি। তারই পৌত্র আমাকে এসব ঘটনার বিশদ বিবরণ শুনিয়েছিল এবং ঝলকারির নির্ভীকতার কাহিনী শুনিয়েছিল। জেনারেল রোজ তার ডায়েরিতে এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ না করলেও কোরিদের মধ্যে এ কাহিনী আজও বহুল প্রচলিত।’ মোহনদাস নৈমিশরায় তো তার উপন্যাসটি লেখার জন্য ঝলকারির সে গ্রামে ভ্রমণ করেছেন, তার উত্তরপুরুষদের খুঁজে বের করেছেন এবং তার সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েছেন।
আর এভাবেই ইতিহাসগ্রন্থে ঝলকারি বাইয়ের বীরগাথা স্থান না পেলেও অগণিত দলিত মানুষের মুখে মুখে তার কাহিনী প্রচলিত হয়ে আছে। লোকমুখে থাকা এসব গল্পই পরবর্তী সময়ে মোহনদাস নৈমিশরায়ের মতো লেখকদের তাড়িত করেছে তাকে নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে। বহু গবেষণার ফলে এটা আজ নির্ধারিত হয়েছে যে তার অস্তিত্ব নিয়ে এখন সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ঐতিহাসিকদের কাছে আজও তিনি আদরণীয় নন। প্রাপ্য সম্মান থেকে ভদ্রলোকেদের ইতিহাস তাকে বঞ্চিত করেছে।
তথ্যনির্দেশ: ১. ভারতীয় নারী-যোদ্ধাএঁ, অরুণ সিনহা, পৃ. ১০০-১০১ ২. যুদ্ধে স্বামীর পরাজয় নিশ্চিত দেখে রাজপুত নারীদের আত্মহননের পথ বেছে নেয়া। ৩. এখানে জেনারেল শব্দটিকে ব্যঙ্গ করে উচ্চারণ করেছেন ঝলকারি বাই ৪. ঝাঁসী কী রানী লক্ষ্মীবাঈ, ডা. বৃন্দাবনলাল বর্মা, পৃ. ২৪০-২৪১ ৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪১ ৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮। লেখক: ইসফানদিয়র আরিওন : লেখক ও অনুবাদক