দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউওনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম (৪২) ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য আসাদুল ইসলামকে (৩৫) দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে দিনাজপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি রাসেদ পারভেজ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিল তাদেরকে বহিষ্কার করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি পত্র তারা পেয়েছেন। এর আগে দিনাজপুরের হাকিমপুর, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট থানা পুলিশ এবং র্যাব রংপুর-১৩ এর একটি দল যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে শুক্রবার ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে হিলির কালিগঞ্জ এলাকায় বোনের বাড়ি থেকে আসাদুল ইসলামকে এবং জাহাঙ্গীর আলমকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তাদেরকে রংপুরে র্যাব-১৩ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হাকিমপুর থানার ওসি ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, আসাদুল ইসলাম ঘোড়াঘাট উপজেলার সাগরপুর গ্রামের এমদাদুল হকের ছেলে। অপরদিকে জাহাঙ্গীর আলম ঘোড়াঘাট উপজেলা রানিগঞ্জের আবুল কালামের ছেলে বলে জানিয়েছেন ঘোড়াঘাট থানার ওসি আমিরুল ইসলাম।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং আসাদুল ইসলাম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। আরও জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলম ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে জাহাঙ্গীর আলম আহ্বায়ক হন। পুলিশ জানায়, বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে দুষ্কৃতকারীরা ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ চত্বরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে। হত্যার উদ্দেশ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তার বাবা ওমর আলীকে কুপিয়ে ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে।
এ ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- রংপুর ডিআইজির একজন প্রতিনিধি এবং দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ মাহমুদ। এছাড়া হামলার ঘটনায় ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে ঘোড়াঘাট থানায় মামলা করেছেন।
শঙ্কামুক্ত নন ওয়াহিদা তবে অবস্থার উন্নতি: দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের গতরাতে অস্ত্রোপচারের পর গতকাল শুক্রবার সিটি স্ক্যান রিপোর্ট শতভাগ ভালো এসেছে। চিকিৎসক ও স্বামীর সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। রাতেই জ্ঞান ফিরেছে ওয়াহিদার। বর্তমানে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রেখেছেন চিকিৎসকরা। শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তার সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করা হয়। এ ব্যাপারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান নিউরো সার্জন এবং গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত তার সব প্যারামিটার খুবই ভালো। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট কেমন আসে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। খুবই ভালো খবর। তার সিটি স্ক্যানের শতভাগ ভালো রিপোর্ট এসেছে।’ তবে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট শতভাগ ভালো এলেও এখনো শঙ্কামুক্ত নন ইউএনও ওয়াহিদা। এ বিষয়ে নিউরো সার্জন মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ইউএনও ওয়াহিদার মাথায় অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই অপারেশন থিয়েটার থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। রাতেই তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। বর্তমানে আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হলেও আমরা শঙ্কামুক্ত বলছি না।’
অন্যদিকে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেছেন, ‘অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই তার জ্ঞান ফিরেছে। এরপর তিনি তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন। বর্তমানে তার হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তার স্বাস্থ্যগত সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়ে আসেনি। আরও পর্যবেক্ষণ শেষে মেডিকেল বোর্ড বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
‘শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে আমাদের মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বৈঠকে বসবেন। এরপর এ বিষয়ে চিকিৎসকরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আপনাদের জানানো হবে। তবে বর্তমানে ইউএনও ওয়াহিদার শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে’, বলেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক। এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে ৬ সদস্যের চিকিৎসক দল প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ইউএনও ওয়াহিদার মাথার জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। অস্ত্রোপচার শেষে তাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রেখেছেন চিকিৎসকরা। তাৎক্ষণিকভাবে তার সেরে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী হলেও তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ওয়াহিদা খানমের মাথায় ভাঙা হাড়ের সাত-আটটি টুকরো অস্ত্রোপচারে জোড়া দিয়েছেন চিকিৎসকরা। আঘাতের কারণে আরও ছোট ছোট যে কাটা ছিল সেগুলোও রিপেয়ার করা হয় বলে বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১২ টার দিকে অস্ত্রোপচার শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে জানান হাসপাতালের নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান নিউরো সার্জন ও গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আশাবাদী কিন্তু এটা হেড ইনজুরির ব্যাপার। তার মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং ব্রেনে আঘাত লেগেছে। ব্রেনের ওপর একটা চাপ ছিল, সেটা আমরা রিলিফ করেছি। তবে এখনই ক্লিয়ারলি আমরা বলতে পারব না যে, রোগী ভালো হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইট উইল টেক টাইম। অন্তত ৭২ ঘণ্টা আমরা তার পরিস্থিতি অবজারভ করব। আমরা আশাবাদী, রোগী ভালো হয়ে যাবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’ এর আগে রাত ৯ টার দিকে তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগে তার সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। প্রেশার চেক করে অবস্থা স্বাভাবিক থাকায় তার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা জানান, দুর্বৃত্তের হামলায় ইউএনও ওয়াহিদার মাথার বাঁ দিকটা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাথার কিছু অংশ ভেঙে ব্রেনে প্রেশার তৈরি করেছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেটি অপসারণ করা গেলে অবস্থার উন্নতি হবে-এমন আশা থেকে তার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দুর্বৃত্তরা সরকারি আবাসিক ভবনে ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে শুরু করে। এ সময় চিৎকারে তার সঙ্গে থাকা বাবা ছুটে এসে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা তাকেও কুপিয়ে জখম করে। পরে অন্য কোয়ার্টারের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশে খবর দেন।
তাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রংপুরে পাঠানো হয়। ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে রংপুর ডক্টরস ক্লিনিকে আইসিইউতে ও তার বাবাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওয়াহিদা খানমকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হয়। এদিকে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবাকে গুরুতর জখম করার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হাকিমপুর, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট থানা পুলিশ এবং র্যাব রংপুর-১৩ এর একটি দল যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে শুক্রবার ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে হিলির কালিগঞ্জ এলাকায় বোনের বাড়ি থেকে আসাদুল ইসলামকে এবং জাহাঙ্গীর আলমকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারদের রংপুরে র্যাব-১৩ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্রেফতার জাহাঙ্গীর আলম (৪২) উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং আসাদুল ইসলাম (৩৫) উপজেলা যুবলীগের সদস্য।