গত কয়েক বছরে দেশে চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অর্থনীতির সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও বড় ভূমিকা রাখছে চালের বাজার পরিস্থিতি। খাদ্যপণ্যটি উৎপাদনকারী দেশের বৈশ্বিক তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে হলেও বাংলাদেশে চালের দাম এশিয়ার উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। পাইকারি পর্যায়ে এমনকি প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে চালের দাম অন্তত ৭০ শতাংশ বেশি বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এক বাজার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। ডলারের বিপরীতে টাকা ও রুপির বিনিময় হারে অসম পরিবর্তনসহ নানা কারণে বর্তমানে এ পার্থক্য কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এফএও ও খাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণসংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এ বাজার পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা হয়। আগস্টের ওই পর্যবেক্ষণে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাজারে চালের পাইকারি দাম প্রতি টন ৫৭০ ডলার। প্রতিবেশী ভারতে তা ৩৩৫ ডলার। আমদানিনির্ভর হওয়ায় বিভিন্ন সময়েই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখিতার জন্য প্রতিবেশী ভারতের বাজার অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করা হয়েছে। বর্তমানে চালের মজুদ বাড়াতে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হয়েছে। কিন্তু ইউএসডিএর হিসাব বলছে, ২৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত করার পরও ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি টন চালের আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৪১৯ ডলারে, যা বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারের মূল্যের চেয়ে অনেক কম।
সরকারের ধানের দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় খুচরা পর্যায়ে চালের বাজারদর এখন কিছুটা কমতির দিকে। গত কয়েকদিনে পণ্যটির দাম কমেছে কেজিতে ৪-৫ টাকা। শিগগিরই তা আরো কমবে বলে আশা করছে সরকার। এর পরেও বাংলাদেশে চালের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বলে বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন ও বিপণন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। তাদের ভাষ্যমতে, এ মুহূর্তে বাজারে দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও চালের বিদ্যমান মজুদ ও আমদানির পাশাপাশি আগামী বোরো মৌসুমের উৎপাদন বাজারের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি ও পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল নাজির বা মিনিকেট নামে যে সরু চাল বিক্রি হয়, তার কেজিপ্রতি দাম ছিল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা, যা গত বছরের একই দিনের (৭ নভেম্বর) চেয়ে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। মাঝারি চালের (পাইজাম/লতা) দাম গতকাল ছিল কেজিপ্রতি ৫৪-৫৮ টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছরের ৭ নভেম্বর যে মোটা চাল (স্বর্ণা/চায়না/ইরি) কেজিপ্রতি ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গত সোমবার তা বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫২ টাকায়। এ সময় মোটা চালের গড় দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাজারে চালের দাম এখনো বেশ অসহনীয় পর্যায়ে। শুধু চালের দামের কারণেই নি¤œ আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবসময়ই দেখা গিয়েছে, কোনো দেশে চালের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। দুই বছর আগে কভিডের প্রাদুর্ভাবকালে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের অভিঘাত গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশে এ অভিঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে নি¤œ আয়ের মানুষ। অর্থনীতির অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে তাদের জীবনযাপন-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। সরবরাহ পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায়ই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বাজারে চালের দাম বারবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে প্রধানত সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবেই চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে দেখা যায়। এ মুহূর্তে বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সামনের দিনগুলোয় চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বড় আশঙ্কার অনেক সুযোগ রয়েছে। চালের দাম বারবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, অর্থায়নসহ নানা বৈষম্যের কারণে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। এর সুবাদে বৃহদায়তনের ব্যবসায়ীরা আরো বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেও বহু চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন, কতিপয় মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও মজুদদারের কারণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। আগে যাদের হাতে ব্যবসা ছিল, তাদের হাতে এখন নেই। হাতে গোনা কয়েকটি লোকের কাছে ব্যবসা চলে গিয়েছে। এর কারণ ব্যাংকের অসহযোগিতা। কাউকে ব্যাংক ৫০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। কাউকে দিয়েছে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। যাদের কম দিয়েছে, তারা বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠার কোনো কারণ নেই। ২০০৯-১৬ পর্যন্ত দাম বাড়েনি, কারণ তখন ন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ ছিল। সব মিল সচল ছিল। ধীরে ধীরে অর্থায়নের প্রেক্ষাপটে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। একজন ব্যবসায়ী আছেন, যিনি ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিদের কারণে এখন বেশির ভাগ মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সেই বন্ধ মিলগুলো ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন বড় মুনাফাখোর কতিপয় ব্যবসায়ী। মূলত তারাই ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণ।
গত বছরের আমন মৌসুমে দেশে চালের বেশ ভালো উৎপাদন হয়েছিল। বোরো মৌসুমেও ফলন হয়েছিল ভালো। কিন্তু গত জুনে দেশের উত্তরা ল ও উত্তর-পূর্বা লে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে আউশ মৌসুমের আবাদ কমে যায়। আবার একই সময়ে বাজারও মারাত্মক অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে জুনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয় সরকার। এ সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবু আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু বারবার শুল্ক কমানোর পরেও পর্যাপ্ত মাত্রায় চাল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে।
চালকল মালিকদের বাজারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকেই পণ্যটির বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি এবং ভারতে শুল্ক আরোপকে দেশের বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। আব্দুল লতিফ মন্ডল বলেন, চালের দাম বেশি হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে আরো আছে, সম্প্রতি বৈশ্বিকভাবে চালের দাম বেড়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে ২৫টি দেশ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দাম বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো পরিবহন খরচ। আমরা মূলত চাল আমদানি করি ভারত থেকে। সম্প্রতি দেশটি থেকেও চাল রফতানিতে শুল্ক বেড়েছে। দেশটি রফতানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় আমাদের অনেক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনাও বড় সমস্যা। বছর দুই আগে বোরো মৌসুমে একটা গবেষণা হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ৬১ শতাংশ ধান ও চাল মজুদ করেন চালকল মালিকরা। ২০ শতাংশ করেন বড় ও মাঝারি কৃষক। বাকি ১৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। ৬১ শতাংশ ধান-চাল মজুদকারীর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ চালকল মালিকদের। এদের প্রভাব এত বেশি, সরকারের কিছুই করার থাকে না।- বণিক বার্তা