বায়ু দূষণে বিশ্বের প্রায় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়ালের’ বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে আজ রবিবার (১৩ নভেম্বর) সকাল থেকে প্রথম অবস্থানে আছে পাকিস্তানের লাহোর। সকাল ৮টার দিকে ঢাকা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। বেলা ১০টার দিকে ভারতের রাজধানী দিল্লি সামনে চলে আসায় ঢাকার অবস্থান নেমে আসে তৃতীয় স্থানে। গত কয়েকদিন ঢাকার দূষণ কিছুটা কম ছিল। তবে আজ তা অন্য কয়েকদিনের তুলনায় অনেক বেশি। সকালে ‘এয়ার ভিজ্যুয়ালের’ বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে ঢাকার মান ২৫৩, যা মাত্রার দিক থেকে খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে। তৃতীয় অবস্থানে যাওয়ার পর ঢাকার মান ছিল ২৩৭। এদিকে প্রথম অবস্থানে পাকিস্তানের লাহোরের মান ছিল ৩০৪। তৃতীয় অবস্থানে থাকার সময় দিল্লির বায়ু দূষণের মান ছিল ২০২, দুই ঘণ্টা পরে তা হয় ২৫৬। সাধারণত ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বলা হয়। তবে কিছু মানুষের জন্য তা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে যারা বায়ু দূষণের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে সংবেদনশীল। এই সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে কর হয়।
গত সপ্তাহে বেশিরভাগ দিনই ঢাকার অবস্থান ছিল ৫ থেকে ১০ এর ঘরে। এদিকে দিল্লি ছিল প্রায় দিনই প্রথম স্থানে। এমনকি দূষণের কারণে গত সপ্তাহে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দিল্লির অনেক স্কুল।
দিল্লির গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায়, একিউআই অনুযায়ী ৫ নভেম্বর দূষণের মাত্রা ছিল ৪০৮ একিউআই। এত বেশি বায়ু দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা। গাড়ির ধোঁয়া এবং পাশের অঞ্চলগুলোতে খড় পোড়ানোর জেরে দিল্লির বাতাস আরও বিষাক্ত হয়েছে। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বাতাসে দূষণের পরিমাণ ছিল ৩৭৬ একিউআই। ৫ নভেম্বর সকালে তা পৌঁছে যায় ৪০৮ একিউআইয়ে। যাকে দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ বলে থাকেন বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞরা। এ সময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হতে বারণও করা হয়ে থাকে। ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্কুল বন্ধের পাশাপাশি দিল্লিতে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে পুরনো ইঞ্জিনের ডিজেল গাড়ির ব্যবহার। এছাড়া বৈদ্যুতিক ও সিএনজি চালিত ট্রাক ছাড়া অন্য ট্রাকের দিল্লিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। শুষ্ক মৌসুম এলেই বেড়ে যায় এই শহরের দূষণের মাত্রা। সরকারি নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে এই মাত্রার পরিমাণ। এর আগে দেশব্যাপী বায়ুমান পরীক্ষা করে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছিল স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস। গাজীপুরের পর ঢাকা দ্বিতীয় এবং নারায়ণগঞ্জ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বলে উঠে এসেছে তাদের গবেষণায়। ক্যাপসের পরিচালক ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের গবেষণার তথ্য তুলে ধরেছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫-কে ঢাকায় দূষণের জন্য বেশি দায়ী করা হয়।
ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২.৫ অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর পিএম-১০ সবচেয়ে বেশি। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড এবং সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর সূচক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, বায়ু দূষণের প্রধান দুই কারণ যানবাহনের ধোঁয়া ও কলকারখানা ধোয়া। শহরে যত গাড়ি চলবে তত দূষণ বাড়বে। পরিবেশের কথা কেউ ভাবছে না। গাড়ির ধোয়াসহ সকালে বেলা ঝাড়ু দেওয়া, ইটভাটাসহ সব ধরনের দূষণের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের এইক্ষেত্রে কিছু করার নেই। সবকিছু সামগ্রিকভাবেই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকার যদি চায় বায়ু দূষণ বন্ধ করতে তাহলেই এটি বন্ধ করা সম্ভব। অন্য দেশে নতুন গাড়ি আনার ক্ষেত্রে কিছু আইন মানা হয়। আমাদের এইখানে এসব নেই। এই দেশে আইন করে গাড়ি ব্যবহার, কলকারখানার ধোয়া এসব নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে জানা যায়, বায়ুদূষণ রোধে এবার শক্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বায়ুদূষণের দায়ে শিল্প কলকারখানাগুলোর ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থার বিধান রেখে নতুন আইন প্রস্তাব করেছে জোটটি। শুধু বায়ুদূষণ নয়, শিল্পাঞ্চলের বিষাক্ত বর্জ্যে পানির দূষণ রোধেও নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। এরই মধ্যে ইইউর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।-বাংলাট্রিবিউন