অর্থনীতিবিদরা আশংকা বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের কাঁধে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা এই লক্ষ্যমাত্রাকে অস্বাভাবিক বলেছেন। তাদের মতে, অর্থবছর শেষে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে ৯০ হাজার ৯০১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৯৭ হাজার ৩০৬ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় হাজার ৪০৪ দশমিক ৮৭ কোটি টাকার মতো ঘাটতি রয়েছে।
অক্টোবর মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৩ হাজার ৭৭৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই মাসে আদায় হয়েছিল ২১ হাজার ৫৯৯ দশমিক ১৯ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অথচ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতে আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ১৮৪ দশমিক ৫৩ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ৪০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। এরপর আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ৯৩৬ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ৪ হাজার ৮০২ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রথম তিন মাসে আয়কর খাতে আসে ২৬ হাজার ৭৮০ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যের চেয়ে ১ হাজার ৫৬১ দশমিক ৪১ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর। যদিও গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের পরিমান ছিল ৭৯ হাজার ৬২২ দশমিক ৬০ কোটি টাকা। চলতি বছরে যা ৯০ হাজার ৯০১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসেবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৮৬২ দশমিক ৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরে ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে এক ধরনের মুদ্রিত অর্থ যা বাজারে প্রবেশ করানো হচ্ছে। মুদ্রিত অর্থ ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। যদি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে ফাঁক ফোকর বন্ধের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে সরকারের ঋণ
চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম তিন মাসের ধারাবাহিকতায় অক্টোবরেও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতিতে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থবছরের চতুর্থ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৪৯ দশমিক ৯২ কোটি টাকা কম আদায় করেছে এনবিআর। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০৪ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। ঘাটতির বৃত্তে ঘুরতে থাকায় চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। একদিকে বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতি, দিনের পর দিন রিজার্ভে টান, ঊর্ধ্বমুখী বাণিজ্য ঘাটতি ও নেতিবাচক রেমিট্যান্স আহরণের ভীড়ে আশার আলো দেখাচ্ছিল রাজস্ব আয়। এবার অর্থনীতির এই সূচকেও হতাশা। এতে সরকারের ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রক্রিয়াতে রয়েছে সমস্যা। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এজন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।
ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্য আমদানি কড়াকড়ি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কমে গেছে পণ্য আমদানি। আর আমদানি কমায় শুল্ক আয় কমেছে। অপরদিকে সব ধরনের পণ্যের দাম চড়া। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের ভোগব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরই প্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভ্যাট আদায়ে।
রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের ওপর চাপটা থাকবে বেশি। তবে এ চাপ এনবিআরের জন্যও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা থাকায় এবারও চাপে থাকবে এনবিআর। এ ছাড়া বিশাল অংকের রাজস্ব আহরণে যে কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতিমালা, সংস্কার কিংবা সক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই। ভ্যাট আইন চালুর পরও সম্পূরক শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে ভ্যাটের পুরো চাপ জনগণের ওপর আসবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাত বিশেষ করে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায় বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ মহল থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক কর আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রকল্প থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পে উৎসে কর থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আসে। বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে প্রকল্প কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক রাজস্ব আয়ে। এছাড়া পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন ভ্যাট আদায় কমেছে, অন্যদিকে আমদানি-রফতানিতে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। এই কারণে রাজস্ব আয়ে আমদানি-রফতানি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অর্থনৈতিক এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের পক্ষে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। তবে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে রাজস্ব আহরণ হবে বলেও আশাবাদ এনবিআরের কর্মকর্তাদের।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রক্রিয়াতে রয়েছে সমস্যা। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমাকেও রাজস্ব ঘাটতির কারণ বলে মনে করেন তারা। তবে এনবিআরকে সক্ষমতা ও করের আওতা বৃদ্ধির পরামর্শ তাদের। এছাড়া বকেয়া টাকাও আদায় করার উপর জোর দেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ বিষয়ে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভলপমেন্ট এর চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয় সেটা কোনো একটা পদ্ধতি অবলম্বন করে দেওয়া হয় না, এটা অনুমান নির্ভর। যে লক্ষ্যমাত্রা দেয় সে অনুযায় যদি রাজস্ব আদার করতে চায় তাহলে তাদের লোকবল আরো বাড়াতে হবে কিন্তু তার সে অনুযায়ী লোকবল বাড়ায় না। বাংলাদেশে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব জনবল বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায় থেকে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে ভাবতে হবে। এছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাতকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে তাহলেও রাজস্ব আদায় বাড়বে।
এনবিআরের সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) মো. জাহিদ হাসান বলেন, করের ফাঁক ফোঁকর বন্ধ করতে হবে। পলিসির যে ফাঁক ফোকর আছে তা রোধ করতে পারলে কর ফাঁকিটা বন্ধ করা যাবে। এতে রাজস্ব আয় বাড়বে এবং ঘাটতি থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. রুমানা হক বলেন, একটাতো হলো আমাদের করজাল (যারা নিয়মিত কর দেয়) ফিক্সড হয়ে আছে, সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে না। নতুন করে অনেককে করের আওতায় আনা যেতে পারে। অনেক ইনফরমাল সেক্টরের কারণে হয়তো এগুলো নিয়মিত করা হয় না, যার কারণে একটা বড় অংশ করের আওতার বাইরে চলে যায়। আর যাদের কর দেয়ার কথা, তারাও সঠিকভাবে দিচ্ছে কিনা, এটাও আরো জোড়ালোভাবে মনিটর করা যেতে পারে। আয়ের একটা বড় অংশ হয়তো অপ্রদর্শিত থাকে কিনা, সেগুলো কিভাবে ট্র্যাক করা যায়; সেগুলোকে দেখা। এজন্য জনবল দরকার আরো।