আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অধিকাংশ পথশিশুর নেই কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান, সুষম খাবার। শিক্ষা? সে তো বহু দূর। পথশিশু শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মা-বাবা ছাড়া ছোট্ট জীবনের দায়ভার নেওয়ার জন্য নিরন্তর পথযাত্রায় এগিয়ে যাওয়া পথিক। যেখানে নেই তাদের কোনো নিরাপত্তা, নেই আদর-ভালোবাসা, নেই নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা। শুধু আছে পেটের ক্ষুধা নিবারণের অবিরাম চেষ্টা। এই চেষ্টার যেন কোনো শেষ নেই। সকাল থেকে রাত অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরে, ফুল বিক্রি করে অথবা কাগজ কুড়িয়ে যতটুকু আয় করতে সক্ষম হয়, তা দিয়েই দিনটা পার করতে পারলেই যেন সব হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের দেশের দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, যার ফলে সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। জন্মের পর থেকে যাদের জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয়, তাদের জীবন যে কতটা বিভীষিকাময়Íভুক্তভোগী ছাড়া এটা অন্যদের অনুমান করা নিতান্তই অসম্ভব। এদের যেন একটাই পরিচয় হয়Íছিন্নমূল শিশু। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রায় লক্ষ করা যায় ঘুমন্ত শিশুদের, যারা গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে ফুটপাতে, যেখানে না আছে পরিচ্ছন্নতা, না নিরাপত্তা।
খোলা মাঠ, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটÍএ সবই পথশিশুদের নিত্যদিনের বাসস্থান। যে বয়সে তাদের পাওয়ার কথা ছিল বাবা-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা, নিরাপদ বাসস্থান, সুষম খাবার, উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ; সেই বয়সে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাদের প্রতিদিনের খাদ্যের জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পথশিশুদের বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে। ক্ষুধার তীব্রতা সহ্য না করতে পেরে বিপথগামী হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে কেউ কেউ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে পথশিশুর সংখ্যা ৪ লাখের মতো এবং অধিকাংশের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। ইউনিসেফের মতে, ১০ লাখের বেশি পথশিশুর বসবাস বাংলাদেশে। বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ শিশুই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকাসক্ত।
২০১৬ সালে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যানহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। এতে বলা হয়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ শতাংশ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। তাছাড়া মেয়েরা রীতিমতো স্বীকার হচ্ছে যৌন নিপীড়নের। ১২-১৩ বছর বয়সি মেয়েরা নানা ধরনের হেনস্তার স্বীকার হচ্ছে। এর ফলে তারা কোথাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। জানা গেছে, প্রয়োজনীয় যতেœর অভাবে প্রতি বছর জলবাহিত রোগে ১ লাখ ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। অথচ প্রতিটি শিশুর সমাজে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
পথশিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের সংস্থা-সংগঠনের কথা বলা হয়ে থাকলেও তাদের কার্যক্রম খুব কমই চোখে পড়ে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা খুবই স্বল্পমেয়াদি হয়, যার ফলে খুব একটা পরিবর্তন চোখে পড়ে না। পথশিশুদের সমস্যার সমাধানের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা জারির মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের বাসস্থান ও সুষম খাবার বণ্টনের মাধ্যমে মানসিক বিকাশ সুনিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখা দরকার, শিশুরা এভাবে অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে গেলে তা ভবিষ্যতের জন্য মোটেও মঙ্গলকর নয়। এবং অবশ্যই বেশি করে মনে রাখা দরকারÍশীত মৌসুম শুরু হয়েছে, যে সময় শীতের প্রকোপে হিম হতে থাকবে পথশিশুদের ছোট্ট শরীর। কী সাংঘাতিক! সুতরাং, আসুন, পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই, শীত থেকে বাঁচাতে তাদের কথা ভাববার সময় বের করি। লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়