মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম বাসস্থান। বাসস্থান আল্লাহ তায়ালার বিরাট নেয়ামত। কুরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ অর্থ : আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল এবং তিনি তোমাদের জন্য পশুচর্মের তাঁবুর ব্যবস্থা করেন। তোমরা ওটাকে সহজ মনে করো ভ্রমণকালে এবং অবস্থানকালে। তিনি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেন পশুর লোম ও কেশ হতে কিছুকালের গৃহসামগ্রী ও ব্যবহার উপকরণ। (সূরা নাহল-৮০)
তাই এ নেয়ামতের শুকরিয়া হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো বাসস্থানের সঠিক ব্যবহার করা। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলামের অতুলনীয় সৌন্দর্যের তালিকায় বাসস্থান ব্যবহারেও রয়েছে চমৎকার নির্দেশনা। এখানে কয়েকটি নির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
১. ঘরে প্রবেশের সময় বিসমিল্লাহ বলে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করা। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: সূত্রে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছেন : যে ব্যক্তি ঘরে প্রবেশের সময় এবং খাবার গ্রহণের সময় আল্লাহর জিকির (বিসমিল্লাহ) বলে, শয়তান তখন (তার সাঙ্গপাঙ্গদের বলে) এ ঘরে আজ তোমাদের থাকার জায়গা নেই এবং রাতের খাবারও নেই। আর যে ব্যক্তি ঘরে প্রবেশের সময় এবং খাবার গ্রহণের সময় আল্লাহর জিকির করল না, তখন শয়তান বলে, এই ঘরে তোমাদের রাত যাপন এবং খাবার গ্রহণের সুযোগ আছে। (মুসলিম-২০১৮)
২. ঘরে প্রবেশের পর সবকিছুর আগে মেসওয়াক করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে; আয়শা রা:কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবীজী ঘরে প্রবেশের সময় প্রথমে কোন কাজ করতেন? তিনি বললেন, মেসওয়াক করতেন। (মুসলিম-২৫৩)
৩. ঘরে প্রবেশ করে গৃহবাসীদের সালাম দেয়া। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: তাকে বলেছেন, হে বৎস! তুমি যখন ঘরে তোমার পরিবারের কাছে যাবে, তখন তাদের সালাম দেবে। এটা তোমার এবং পরিবারের জন্য বরকতের কারণ হবে। (সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব-১৬০৮)
৪. ঘরে কেউ না থাকলে নিজেকে সালাম দেয়া। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: সূত্রে বর্ণিত। নবীজী সা: বলেছেন, খালি ঘরে প্রবেশের সময় বলবেÑ আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন। (আল আদাবুল মুফরাদ-১০৫৫)
৫. অন্যের ঘরে প্রবেশের সময় অনুমতি নেয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য কারো গৃহে তাদের অনুমতি না নিয়ে এবং সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না। (সূরা নূর-২৭)
৬. অনুমতি চাওয়ার সময় দরজা বরাবর দাঁড়াবে না। বরং ডানে বা বামে দাঁড়াবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুছর রা: থেকে বর্ণিত আছে, নবী কারিম সা: যখন কারো বাড়িতে আসতেন তখন ঠিক দরজা বরাবর দাঁড়াতেন না। বরং ডানে কিংবা বামে দাঁড়িয়ে বলতেন, আসসালামু আলাইকুম। (আবু দাউদ-৫১৮৬)
৭. দরজায় সজোরে নক না করা। তিনবার নক করার পর অনুমতি দিলে প্রবেশ করা। না হয় ফিরে আসা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও তাহলে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি দেয়া হয়। আর যদি তোমাদের বলা হয় ফিরে যাও, তবে তোমরা ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। (সূরা নূর-২৮)
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা কারো ঘরের দরজা বরাবর দাঁড়াবে না বরং দরজার একপাশ থেকে সালাম দেবে, যদি অনুমতি দেয় প্রবেশ করবে। ফিরে যেতে বললে ফিরে যাবে। (সিলসিলাতুস সহিহা-৭/১০)
৮. ঘরকে গুনাহের আসবাবপত্র, ছবি এবং পুতুল ইত্যাদি যেগুলো ঘরে ফেরেশতা প্রবেশে প্রতিবন্ধক হয় তা থেকে মুক্ত রাখা। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, নবীজী সা: বলেন, যে ঘরে কোনো ছবি কিংবা পুতুল থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (মুসলিম-২১০৬)
আরেক হাদিসে এরশাদ হয়েছে, যে ঘরে কুকুর কিংবা ছবি থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না (বুখারি-৩২২৫)। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ঘরে কোনো বাদ্যযন্ত্র কিংবা ঘণ্টী থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (নাসায়ি-৫২৩৭)
৯. ঘরে কুরআন তিলাওয়াত করা। হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘর বসবাসকারীদের জন্য প্রশস্ত হয় এবং ফেরেশতা প্রবেশ করে, বরকত বৃদ্ধি পায় এবং শয়তান দূরে থাকে। আর যে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় না, সে ঘর বসবাসকারীদের জন্য সঙ্কীর্ণ হয়। ফেরেশতারা দূর হয়ে যায়। শয়তানের আনাগোনা বাড়ে এবং বরকত কমে যায়। (সুনানে দারেমি-২/৫২২)
১০. ঘরে নফল নামাজ আদায় করা। ইবনে ওমর রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের ঘরগুলোতে (নফল) নামাজ আদায় করো। এগুলোকে করব বানিও না। (বুখারি-৪৩২)
১১. মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে একে অপরের রুমে প্রবেশ করতে অনুমতি নেয়া। হজরত আতা ইবনে ইয়াসার রহ: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবীজীকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আমার মায়ের রুমে যেতে অনুমতি নেবো? রাসূল বললেন, তুমি তোমার মায়ের রুমে যেতেও অনুমতি নেবে। লোকটি বলল, আমি তো তার ঘরেই থাকি! নবীজী বললেন, তবুও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, আমি তো মায়ের খেদমত করি! নবীজী বললেন, তুমি কি পছন্দ করো তোমার মাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে? সে বলল, না। রাসূল সা: বললেন, তাহলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করো। (মুয়াত্তা মালেক-১৭৫৯)
আতা রহ: সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস রা:কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি আমার বোনের রুমে যেতে অনুমতি নেবো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সে তো আমার ঘরেই থাকে! তিনি বললেন, তুমি কি তাকে বিবস্ত্র দেখতে পছন্দ করো? সুতরাং বোনের রুমে যেতেও অনুমতি নেবে। (আদাবুল মুফরাদ-৮১১)
১২. ঘরে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত থাকা। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, হজরত আয়েশা রা:কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; নবীজী ঘরে থাকা অবস্থায় কী করেন? তিনি বললেন, নবীজী ঘরে থাকা অবস্থায় কখনো নিজের জুতা সেলাই করতেন কিংবা কাপড় তালি দিতেন। অর্থাৎ পুরুষ লোক ঘরে যেসব কাজ করে নবীজী ঘরে সেসব কাজ করতেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান-৫৬৭৭)
১৩. কোনো ঘরে একাকী রাত যাপন না করা। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত। নবী কারিম সা: কোনো ঘরে একাকী রাত যাপন করতে এবং একাকী দূরবর্তী সফর করতে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ-৫৬৫০)
১৪. ঘুমানোর আগে ঘরের দরজা, হাঁড়ি পাতিলের মুখ ও বাতি বন্ধ করা। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। নবী কারিম সা: বলেছেন, তোমরা হাঁড়ি পাতিলের মুখ ঢেকে রাখবে। দরজা বন্ধ রাখবে। বাতি নিভিয়ে রাখবে। (বুখারি-৫৬২৩)
১৫. ঘরে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিছানা না রাখা। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবীজী তাকে বলেছেন, ঘরে একটি বিছানা থাকে পুরুষের জন্য। আরেকটি নারীর জন্য। আরেকটি মেহমানের জন্য। আর চতুর্থটি থাকে শয়তানের জন্য। (মুসলিম-২০৮৪) আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাসস্থানের আদব রক্ষা করে বসবাস করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।