ইসলাম মানবপ্রকৃতির অনুকূল ও জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম। মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোর কোনোটিই ইসলাম উপেক্ষা করেনি। এমনকি মানবজাতির স্বাভাবিক বিকাশ ও অস্ত্বিত্ব থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুস্থতা ও অসুস্থতা সব কিছুর ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভাষ্য আছে ইসলামের। আধুনিক বিজ্ঞান ইসলামের এই সামগ্রিকতার সাক্ষ্য দেয়। জেনেটিকস সায়েন্স বা বংশগতিবিদ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়। আধুনিক বংশগতিবিদ্যা ও ইসলামের ভাষ্য-বিধানের মধ্যে বিস্ময়কর কিছু মিল আছে। নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো
১. বৈশিষ্ট্য ধারণ : আধুনিক বংশগতিবিদ্যার (Genetics) দাবি হলো, পৃথিবীর সব জীব তার নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রায় অবিকল স্থানান্তর ও পরস্ফুিটিত হয়। পৃথিবীর সব জীবের ক্ষেত্রেই এই প্রাকৃতিক নিয়ম প্রযোজ্য। (জীববিজ্ঞান, নবম-দশম শ্রেণি, পৃষ্ঠা ২৫৬) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিসে উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘বনু ফাজারা গোত্রের এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমার স্ত্রী একটি কালো সন্তান প্রসব করেছে (আমি তো কালো নই)। তখন নবী (সা.) বললেন, তোমার কাছে কি কোনো উট আছে? সে বলল হ্যাঁ, আমার উট আছে। তিনি বললেন, সেগুলোর রং কী রকম? সে বলল, লাল রঙের। তিনি বললেন, তাতে মেটে রঙেরও আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ, মেটে রঙের আছে। তিনি বললেন, এই মেটে রং কোথা থেকে এলো? সে বলল, সম্ভবত তা পূর্ববর্তী বংশধারা থেকে নিয়ে এসেছে। তখন তিনি বললেন, তোমার এই কালো সন্তানটিও সম্ভবত পূর্ববর্তী বংশধারা থেকে এসেছে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৬৫৮)
২. বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসে : আধুনিক বংশগতিবিদ্যা বলে, ক্রোমোজোম, ডিএনএ, আরএনএ ও জিনের মাধ্যমে জীবের দেহে পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য যেমন স্থানান্তরিত হয়, তেমনি প্রতিটি জীব তার পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান যাকে বিবর্তন বলে। (জীববিজ্ঞান, নবম-দশম শ্রেণি, পৃষ্ঠা ২৭০)
বিবর্তনবাদের সঙ্গে ইসলাম পুরোপুরি একমত না হলেও জীবের জীবনধারা ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনকে স্বীকার করে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে উত্তম নারী গ্রহণ কোরো এবং সমতা (কুফু) বিবেচনায় বিয়ে কোরো, আর বিয়ে দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ রাখো। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৯৬৮)
৩. মায়ের ভূমিকাই মুখ্য : জেনেটিক সায়েন্সের দাবি হলো, জিনগত বৈশিষ্ট্য ধারণ ও স্থানান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে পিতার তুলনায় মাতার ভূমিকাই মুখ্য। বিশেষত জিনগত অসুখগুলো। কেননা মেয়েরা দুটি ঢ ক্রোমোজোম বহন করে, যা আকারে বড় এবং পুরুষ একটি ঢ ও একটি ণ ক্রোমোজোম বহন করে। এ জন্য বংশীয় বৈশিষ্ট্য বিস্তারে নারীর ভূমিকা মুখ্য। (জীববিজ্ঞান, নবম-দশম শ্রেণি, পৃষ্ঠা ২৬৭) পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা নারীর এই মুখ্য ভূমিকার ধারণা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। ’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৪)
উল্লিখিত আয়াতে ‘ওয়াহনুন’ শব্দটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যা ক্লান্তি ও গ্লানির অর্থ দেয়। এখানে ‘কষ্টের পর কষ্ট’ যেমন মায়ের মুখ্য ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে, তেমনি ক্লান্তি ও গ্লানি শব্দ বংশগত অসুখের প্রতি সতর্ক করে।
৪. বংশগতি ও পরিবেশ : জেনেটিক সায়েন্সের বলে, ব্যক্তির যেসব বৈশিষ্ট্যাবলির প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাকে Phenotype বলে। এই Phenotype শুধু ব্যক্তির উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে না; বরং গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে পরিবেশের প্রভাব প্রতিটি মানবশিশুকে স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তিতে পরিণত করে। বংশগতি ও পরিবেশের পারস্পরিক প্রভাবকে বিজ্ঞানীরা Nature-nurture Interaction বলেছেন। (জীববিজ্ঞান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিট-১, পৃষ্ঠা ১৯) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিসে সন্তানের ওপর গর্ভকালীন পরিবেশের প্রভাবের ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই হতভাগ্য যে তার মায়ের পেটে হতভাগ্য এবং সৌভাগ্যবান যে তার মায়ের পেটেই সৌভাগ্যবান। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৬; সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৮)
৫. নিকটাত্মীয় বিয়ে নিষিদ্ধ : আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মানুষ যখন ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ যেমন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই-বোনকে অথবা সেকেন্ডে ডিগ্রি রিলেটিভ যেমন বাবা বা মায়ের চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাই-বোনের সন্তানদের বিয়ে করে। এই দুই ধরনের আত্মীয়ের বিয়ে করলে নানা বংশগত রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বিশেষত জিনবাহিত বংশধারার রোগগুলোর প্রকোপ এতে বাড়ে। অসুস্থ জিনগুলোর কার্বন কপি যখন মা-বাবা দুই বাহক থেকে সন্তানে বাহিত হয়, তখন তা তীব্র আকারে প্রকাশ পায়। (বিবিসি বাংলা)
যদি ফুফাতো, মামাতো ও খালাতো ভাই-বোনের বিয়েতে রোগের ঝুঁকি এত প্রবল হয়, তবে এর থেকেও যারা বেশি আপন তাদের বিয়েতে ঝুঁকি কতটা বেশি তা সহজেই অনুমেয়। পবিত্র কোরআনে এমন নিকটাত্মীয়ের বিয়ে নিষিদ্ধ করে বলেছে, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, কন্যা বোন, ফুফু, খালা, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, দুধ মা, দুধ বোন, শাশুড়ি, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সঙ্গে সংগত হয়েছো তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত কন্যা… তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী ও দুই বোনকে একত্র করা। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৩) আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।