আজ মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের একাদশ দিন । ১৯৭১ সালে এদিনও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্মুখ সমর চলে। এদিনের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল টাঙ্গাইল শহরের মুক্তি অর্জন, যার মধ্য দিয়ে ঢাকা মুক্ত তথা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথ খুলে দেয়। একাত্তরে এদিন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশী নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেবার জন্যে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র মি. রোনাল্ড জিগলার বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। একই দিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নিহাত করিম এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান সংকটকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন, কেউ শক্তি প্রয়োগ করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু ভারত এবং তার মিত্ররা তাই করছে। সন্তোষজনক সমাধান করতে হলে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি এবং পাকিস্তানের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে হবে।
এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় কোনো হামলা চালায়নি। বিদেশী যাত্রীদের সুবিধার্থে তেজগাঁও বিমানবন্দরে মেরামত ও যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। পাকিস্তানী সেনাদের ওপর ঢাকা ত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ডা. এম এ মালিক জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এ আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। পাকিস্তানী সেনাদের সামনে একটি উপায় ছিল আত্মসমর্পণ করা। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানীদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জরুরি আবেদন জানান। এদিকে ঢাকায় বিকাল তিনটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
এদিকে মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচ- প্রতিরোধের মুখোমুখি পড়ে। মার্কিন সপ্তম নৌবিহারের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে। মৌলবীবাজারের পতন আর নরসিংদীতে যৌথবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারা রাত যুদ্ধের পর পাকিস্তানীরা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এদিন জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচ- সংঘর্ষের পর পাকিস্তানী বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। পলায়নের সময় তারা রাস্তার সমস্ত বড় বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়।
অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর একটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ৬ দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচন্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর মুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানী বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ৬ জন অফিসার ও ৫২২ জন সেনা যৌথবাহিনীর আছে আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ২১২ জন নিহত হয়। আহত হয় ২০০ জন। (গ্রন্থনা: ইবরাহীম খলিল)