রাসূলুল্লাহ সা:-এর খুলুকে আজিম তথা মহান চরিত্রের মাধুর্যতাই মক্কার আইয়্যামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগের মানুষগুলোকে ইসলামের ছায়াতলে আনতে ও বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে।
ইসলাম জোরজবরদস্তিতে বিশ্বাস করে না বলেই রাসূলুল্লাহ সা: সীমাহীন নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করার পরও এর কোনো প্রতিশোধ না নিয়ে উত্তম আদর্শের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন।
মুশরিকদের অত্যাচারে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা ছাড়তে হয়েছে, ওহুদ যুদ্ধে তার দান্দান (দাঁত) মোবারক শহীদ হয়েছে, দুশমনদের আঘাতে তার সারা দেহ রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে রইল, সাহাবায়ে কেরাম তার এই কষ্ট দেখে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করার অনুরোধ করলে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমি বদদোয়া দেয়ার জন্য প্রেরিত হইনি, আমি আগমন করেছি বিশ্ববাসীর সামগ্রিক কল্যাণের উজ্জ্বল প্রতীকরূপে।’ দ্বীনের দাওয়াত দিতে যখন রাসূল সা: তায়েফ গমন করেন ইসলামের দুশমনরা তার ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে।
আঘাতে আঘাতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর দেহ মোবারক হয়েছে ক্ষতবিক্ষত।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর এই অবস্থা দেখে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মাধ্যমে এ প্রস্তাব দিলেন যে, হে আল্লাহর রাসূল সা:! আপনি যদি অনুমতি দান করেন তাহলে দু’দিকের পাহাড় একত্র করে এই বেঈমানদের নিশ্চিহ্ন করে দিই। রাসূল সা: ফেরেশতাদের বললেন, ‘না। এদেরকে শাস্তি দিও না। এরা আমাকে চিনতে পারেনি। হতে পারে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কালেমা পড়ে একদিন মুসলমান হয়ে যাবে।’ নিজে এত নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেও কোনো প্রকারের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বরং নির্যাতনকারীদের কল্যাণ কামনা করেছেন।
কিন্তু এতটা নির্যাতনের শিকার হয়েও পরবর্তী সময়ে কিভাবে তিনি ইসলামের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন? এর উত্তর হলো আদর্শের মাধ্যমে। কারণ রাসূলুল্লাহ সা:-এর দাওয়াতের সাফল্যে তার উত্তম মাধুর্যের চরিত্র ও আদর্শই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শ নিঃসন্দেহে মানুষকে ইসলাম গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করেছে।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর চরিত্রের প্রশংসা করে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল! নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা ক্বলম-৪) রাসূলুল্লাহ সা: তার উত্তম আদর্শের মাধ্যমেই কাফের, মুশরিকদের ইসলামের দিকে আহ্বান করেছেন।
একদিন প্রিয়নবী সা: দেখলেন জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে এক বৃদ্ধা মাথায় করে নিয়ে আসছে। বোঝার ভারে বৃদ্ধার খুব কষ্ট হচ্ছে। বৃদ্ধার কষ্ট দেখে রাসূল সা: বললেন, ‘মা, বোঝাটি আমার কাঁধে তুলে দাও, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ বৃদ্ধা তখন তার বোঝাটি রাসূল সা:-এর কাঁধে তুলে দিলে রাসূল সা: বোঝাটি নিজ কাঁধে বহন করে বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। ফিরে আসার সময় বৃদ্ধা রাসূল সা:-কে কিছু আপ্যায়ন করতে চাইলেও তার বাড়িতে খাবারের কিছুই ছিল না। বৃদ্ধা তখন আফসোস করে বলল, আমার ঘরে যে কিছুই নেই যা দিয়ে তোমাকে আপ্যায়ন করতে পারি। কিন্তু বাবা, তোমাকে একটি উপদেশ দিচ্ছি, মক্কায় এক যুবক নিজেকে নবী দাবি করে তার নাম মুহাম্মদ। সে আমাদের পূর্বপুরুষদের বিরোধিতা করে আসছে। তুমি যেহেতু খুব ভালো মানুষ, আমাকে অনেক উপকার করেছ তাই তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি- এ যুবকের কথায় তুমি কখনো কর্ণপাত করবে না। রাসূলুল্লাহ সা: বৃদ্ধার কথা শুনে বললেন- ‘মা, তোমার কথা কি শেষ?’ বৃদ্ধা বলল হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যে যুবক সম্পর্কে আমাকে উপদেশ দিয়েছ আমিই সেই যুবক। আমার নামই মুহাম্মদ। আমিই এক আল্লাহর একাত্মবাদের দাওয়াত দিই।’ বৃদ্ধা বলল, সত্যিই তুমি সেই যুবক? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হ্যাঁ’। বৃদ্ধা তখন বলল, যদি তাই হয় তাহলে আমি নিজে এখন কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাবো, তাড়াতাড়ি আমাকে কালেমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে দাও। এর পর বৃদ্ধা কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। এই বৃদ্ধাকে জোরজবরদস্তি করে মুসলমান বানানো হয়নি; বরং রাসূলুল্লাহ সা:-এর উত্তম চরিত্র ও আদর্শ দেখে নিজ থেকেই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। রাসূলে আরাবি সা:-এর অন্যতম এক আদর্শ হলো মানুষের সেবা করা। এই সেবার মাধ্যমেই ইসলামের দাওয়াতের মিশন চালু রাখা বর্তমান সময়ে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। আজ দ্বীনের দাঈদের প্রয়োজন মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করা।
সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র, এতিম, বিধবাসহ পিছিয়েপড়া জনগণের প্রয়োজনে সর্বাত্মকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো রাসূল সা:-এর সুন্নতও বটে। আজো যদি বিশ্ব মুসলিম রাসূলুল্লাহ সা:-এর উত্তম চরিত্র আর আদর্শ গ্রহণ করে জীবন যাপন করে তাহলে বিশ্বের বুকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হতে বাধ্য। লেখক : নাজিমে দারুল ইকামাহ, জামিয়া কুরআনিয়া সৈয়দা সৈয়দুন্নেছা ও কারিগরি শিক্ষালয়, কাজীপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া