উত্তরের জেলা দিনাজপুরে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা কমছে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করছে জনপদ। কুয়াশার কারণে সকালেও আলো জ্বেলে চলছে যানবাহন। বইছে শৈত্য প্রবাহ। শীতে কাঁপছে দেশ। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সারা দেশের মানুষ। অসহায় দরিদ্র মানুষ বিশেষ করে শিশুদের ভোগান্তির শেষ নেই। মানুষ তো মানুষেরই জন্য। তাই এ সময়ে আসুন আমরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই। নিজ নিজ এলাকা থেকে নতুন কিংবা পুরনো শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে । আপনাদের দেয়া একটি পুরনো শীতবস্ত্র একজন শীতার্ত মানুষের শীত নিবারণের অবলম্বন হতে পারে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসেই দেখা দেবে শৈত্যপ্রবাহ, সেই সঙ্গে হালকা বৃষ্টিপাতও হতে পারে। এতে তাপমাত্রা ৮ থেকে ৬ ডিগ্রি পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
দিনাজপুরে গত কয়েকদিন ধরেই ঘন কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকছে। সূর্য উঠলেও প্রখরতা নেই। এই সময়টাতে লোকজন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। ঘন কুয়াশার পাশাপাশি কনকনে ঠান্ডাও জেঁকে বসতে শুরু করেছে। কৃষিজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের কাজে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। গতকাল বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘন কুয়াশা ঢেকে রেখেছে চারপাশ। সকাল ১০টা পর্যন্ত একই অবস্থা। যদিও সকাল ৯ টার পরেই সূর্যের দেখা মিলেছে, তবে প্রখরতা নেই। এই সময়টাতে সড়ক ও মহাসড়কে যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। দিনাজপুর শহরের পার্শ্ববর্তী সুখসাগর এলাকার লতিফুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ইজিবাইক নিয়ে বের হই। এই সময়ে ইজিবাইকের চলাচল কম হওয়ায় যাত্রী ভালো পাওয়া যায়। তবে গত কয়েকদিন ধরে সকালে যাত্রীদের উপস্থিতি একেবারেই কম। শীতের কারণে মানুষজন বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। আমিও যে ইজিবাইক চালাচ্ছি তাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় হাত-পা জড়ো হয়ে যাচ্ছে।’
একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে কিছু শাক বিক্রির জন্য সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলাম। সেগুলো বাহাদুরবাজারে দিয়ে আসলাম। কিন্তু সকালে এমন অবস্থা যে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে রাখতে পারছিলাম না। ঠান্ডায় হাত বরফ হয়ে যাচ্ছিল যেন।’ সদরের চেহেলগাজী ইউনিয়নের গোপালগঞ্জ এলাকার ফিরোজ ইসলাম বলেন, ‘এখন ধানের বীজ বপন করার সময়। মাঠে আলু রয়েছে। যদি এমনভাবে কুয়াশা হয় তাহলে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। এই সময়ে আমরা খুব ভয়ে থাকি। কয়েকদিন ধরেই ঘন কুয়াশা, তাই আলুতে বালাইনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে।’ রাজবাটী এলাকার সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রচন্ড ঠান্ডা। কাজ-কাম হচ্ছে না। সকালে ঠান্ডার কারণে বের হওয়া যাচ্ছে না। এই সময়টা আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটু সমস্যাই বটে।’ দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, বুধবার জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সোমবার ছিল ১৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জেলা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও আজ সকাল থেকেই ঘন কুয়াশা ছিল। এই তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমে যেতে পারে এবং এই মাসেই একটি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে একটি হালকা বৃষ্টিপাতও হতে পারে।
উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশে বিভিন্ন বিভাগের নিম্ন শ্রেণির মানুষের খবর রাখে না তেমন কেউ। শহরে অনেক পথশিশু আছে বৃদ্ধ আছেন রাস্তায় তাদের রাত রাস্তায় তাদের দিন কাটে। যাদের পোশাক বলতে তেমন কিছুই নেই আর শীতবস্ত্র তো কল্পনায় বিলাসিতা। রাস্তার পাশে থাকা মানুষটিও আমাদের মতো মানুষ। সৃষ্টি কর্মকর্তা চাইলে আমরা তাদের অবস্থানে থাকতে পারতাম, শুকরিয়া তিনি আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন। তাদের একটু সাহায্য করা আমাদের যেমন সামাজিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধের পরিচয় পাবে তেমনিভাবে অনেক পুণ্যও অর্জন হবে। এবারের অবস্থা একটু আশঙ্কাজনক হতে পারে বলে মনে করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদগণ।
গত বছরের শীতকাল ছিল তুলনামূলকভাবে উষ্ণ, মানে শীত ছিল কম। নভেম্বর-ডিসেম্বর পেরিয়ে জানুয়ারিতে গিয়েও গত বছর শীত জেঁকে বসেনি। সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে কুয়াশা ও শীত নামতে শুরু করে। গত মাসে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ১৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের জনপদে ঘন কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। গত ১৫ অক্টোবর পঞ্চগড় সদর উপজেলা ও উত্তরের জনপদে ঘন কুয়াশা ছিলো অনেকটা আগমনী শীতের বার্তা। এবার এরই মধ্যে চলতি মাসে রংপুর বিভাগে রীতিমতো শীত নেমে গেছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, সাধারণত বাংলাদেশে শীত নামে ডিসেম্বরে, এবার নভেম্বরেই শীত নামতে শুরু করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, জানুয়ারি মাস আমাদের দেশে সবচেয়ে শীতল থাকে। গত বছর জানুয়ারিতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা ছিল। তবে এবার নভেম্বর থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও যশোর-চুয়াডাঙ্গায় শীত পড়া শুরু করেছে। এবার শীত আগেভাগে নামতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে আবহাওয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের আবহাওয়া চক্রে এ বছরটা একটু অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এর আগে টানা তিন বছর প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনার প্রভাব ছিল না। সাধারণত এক থেকে দুই বছর ওই অঞ্চলে লা নিনা থাকে। যে বছর লা নিনা থাকে, সে বছর প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝবরাবর তাপমাত্রা বেড়ে একটি উষ্ণ রেখা তৈরি হয়। আর বাতাস পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বয়ে যায়। এতে উষ্ণ বাতাস ও পানি প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে আসে। লা নিনার এ ধরনের আচরণের ফলে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ বিস্তৃত অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, ফলে শীত বেশি পড়ে। দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা আবারও শীর্ষে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে এবারের অবস্থা মাত্রার চেয়ে ১৬ গুণ খারাপ। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ভারত মহাসাগরে আবহাওয়ার আরেকটি ধরন বা প্রভাবকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনেকটা লা নিনার মতো প্রভাব সৃষ্টিকারী ওই অবস্থাকে বলে ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপল বা ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র (আইওডি)। এটি সক্রিয় থাকলে বাংলাদেশ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় শীতকাল উষ্ণ থাকে, অর্থাৎ শীত কম পড়ে। গত বছর আইওডি সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশে শীত কম ছিল বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা। তবে এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া সরকারের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ব্যুরো অব মেট্রোলজি থেকে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত আবহাওয়া কেমন যাবে, তার একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইওডি সক্রিয় নেই। এটি নেতিবাচক অবস্থায় আছে। ফলে এবার ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর এলাকায় তাপমাত্রা কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ চৌধুরী এল নিনো-লা নিনা নিয়ে তিন যুগ ধরে গবেষণা করছেন। তিনিও বলেছেন, এবার বাংলাদেশে শীতকাল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দীর্ঘ হবে, তীব্রতাও বেশি থাকতে পারে। ফলে এবার ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে আরও বেশি নি¤œচাপ ও ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। আবার শীত তুলনামূলক একটু বেশি হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদগণ।