বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ঝুলছে অনিশ্চয়তার সুতায়। কী ঘটবে-এর মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে সবকিছু। নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী? কেউ জানে না। আন্দোলনের পরিণতি কী? কেউ জানে না। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের সুরাহা কোথায়? কেউ জানে না। এমনই ঘোরতর দোলাচলে সামগ্রিক পরিস্থিতি।
৪ অক্টোবর ২০২২, মঙ্গলবার মানবজমিনে এ সংক্রান্ত একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশ পেয়েছে। অনেকের মনেই সন্দেহ ও প্রশ্ন: পরিস্থিতি বিগড়ে গিয়ে ২০১৪ সনে যা ঘটেছিল আবারো কী তার পুনরাবৃত্তি হবে? সহিংসতা ফিরে আসবে? কারণ, আগামীদিনে কী ঘটবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত। জরুরি অবস্থা জারিই কি সমাধান? চলমান অনিশ্চয়তার কারণে এমন আশঙ্কাও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে মানুষের মনে। সবদিক বিবেচনা করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গতিশীলতা নিয়েও ভাবছেন অনেকেই। তবে, কোনও ভাবনার অবসান হয়ে সুরাহা হচ্ছে না অনিশ্চয়তার, এটাই চিন্তার বিষয়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বিষয়টি এতোটাই দৃশ্যমান যে, কেউ তা অস্বীকার করতে পারছেন না। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘সামনে রাজনৈতিক সংঘাত নয়, অনিশ্চয়তা আছে।
রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। তবে আশা করি, ঝড় আসবে না। রাজনীতিবিদদের আলোচনার পথে আসতে হবে-সভ্যতা-ভব্যতার পথে আসতে হবে।’ কিন্তু আলোচনার পথও অনিশ্চয়তার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। বিএনপি ও আন্দোলনকারী দলগুলো সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘এই সরকারের সাথে আলোচনা নয়। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়।’ তাদের মিছিল, মিটিং, সমাবেশ থেকে জোর স্লোগান উঠছে, ‘ফায়সালা হবে রাজপথে।’
এমন অবস্থায় সংলাপ ও সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অনিশ্চয়তা কাটানোর উদ্যোগও ক্ষীণতর হচ্ছে। অতীতে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে অচলাবস্থা এবং রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার উদ্ভব হলে নাগরিক সমাজ, সিভিল সোসাইটি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সমাধান ও সমঝোতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তারাও এখন নীরব। বিভিন্ন পক্ষের একগুঁয়েমি ও উগ্রতা দেখে মধ্যস্থতার সাহস করছেন না কেউই। অনিশ্চয়তার মূল কারণ হলো, কোনও পক্ষই অন্য পক্ষকে আস্থায় নিতে পারছেন না। কারো প্রতিই কারো বিশ্বাস নেই। রাজনৈতিক পরিসরে তৈরি হয়েছে দূরত্ব আর ফাটল। নানা পক্ষ নিজেদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এর থেকে বের হওয়ার কোনও পথ কারোই জানা নেই আপাতত। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সঙ্কটও ক্রমশ ঘণীভূত হচ্ছে নানা কারণে। বিশ্বপরিস্থিতিতে চলমান সঙ্ঘাতের ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে নানা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা নানা আশঙ্কার কথা বলছেন। যার প্রমাণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কর্মসংস্থান হ্রাস ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই আর্থিক মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। এসব বিপদ উত্তরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে, তখন আমরা বিভেদ ও অনিশ্চয়তার রাজনীতিতে আবর্তিত। ফলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যে আমাদের আর্থিক অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়াবে, তা বলাই বাহুল্য।
বর্তমান বিশ্বে রাজনীতির মূল সূত্রই হচ্ছে ‘অর্থনৈতিক রাজনীতি’। একুশ শতকে কেউ আর দেশ দখল করেনা, করে বাজার দখল। মিডল ইস্ট, আফগানিস্তান এগুলো সব বড় বড় উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। একটি দেশের সম্ভাবনাকে শেষ করতে হলে তার আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি করে দিলেই কেল্লাফতে। দেশটি কিছুদিনের মধ্যেই দেউলিয়া কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসটা দেখা যাবে, কিন্তু কিছুই করার থাকবেনা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে পিছনে টেনে ধরেছে। এ অবস্থা চলতেই থাকলে বাংলদেশের সামনে বড় এক অন্ধকার দেখা দেবে, যাকে আবার আলোর পথে নিতে যুগের পর যুগ সময় লাগবে। তখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ভেসে যাবে।
সাম্প্রতিককালে চলমান অনিশ্চয়তা, বিভেদ ও সংঘাতময় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি দেখে এবং তা নিরসনের আশা না দেখে সাধারণ মানুষ হতাশ হচ্ছে। রাজনীতির মাঠে তৎপর সবাই যদি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ চলে যায়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? আবার এটাও কেউ জানে না যে, এই অনিশ্চয়তা দীর্ঘস্থায়ী নাকি ক্ষণস্থায়ী হবে। যে উত্তপ্ত রাজনীতির অধ্যায় অলরেডি শুরু হয়ে যেতে দেখেছি, তা পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। । নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদগণ মনে করছেন- রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করা উচিত। কিন্তু সেসব মানছে বা শুনছে কে?
সরকার বার বার বলেছে, বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারে না। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। দলটির তেমন জনসমর্থন নেই। হেন কোনো কথা নেই বিএনপি নিয়ে বলা হয়নি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু সব সমালোচনাকে মোকাবিলা করে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। আগের থেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে এখন দলটি। বিএনপির আন্দোলনে নতুন মাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভাষা ও কর্মসূচির কৌশলে পরিবর্তন এনেছে দলটি। দলটির নেতাদের কথাবার্তায় বেশ আত্মপ্রত্যয়ও লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে মোটেও সরে যেতে প্রস্তুত নয় দলটির নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির এই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ হচ্ছে কৌশলী কর্মসূচি ও তৃণমূলের উত্থান। গত কয়েক মাসের বিভিন্ন কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে বিএনপির তৃণমূলের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও নানা স্বার্থ থাকলেও তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের বার্তা পরিষ্কার। তাঁরা আন্দোলনের মাঠে থাকতে চান। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির চারজন কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও মিছিলে উপস্থিতি কমেনি। বরং দিন দিন উপস্থিতি বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার কোন পথে চলবে? যদি শক্তি দিয়ে বিরোধিতার মোকাবেলা করা হয়, তাহলে সংঘাত আরও বাড়বে। সঙ্কট ও অনিশ্চয়তা আরও গভীর হবে। অতীতের পর্যালোচনায় এটা প্রমাণিত সত্য যে, সংঘাত কখনওই শান্তি আনে না। বরং আরও সংঘাতের জন্ম দেয়। ফলে কৌশলের মাধ্যমে ঠা-া মাথায় পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সমঝোতামূলক পথ ছাড়া অন্য কোনও ভালো বিকল্প আপাতত কারো সামনেই খোলা নেই। কিন্তু সমঝোতার পথে চলার ইচ্ছা ও লক্ষণ কেউ দেখাচ্ছে না। তারপরও আন্দোলন নিয়ে সহিংস পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আশু সমাধান প্রয়োজন। কারণ, প্রকৃত গণতন্ত্রে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলের যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, তা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূল নির্বাচনের মাধ্যমে বজায় রাখা অতীব জরুরি। এ পথ রুদ্ধ করা হলে অনিশ্চয়তার ঘোলাটে রাজনৈতিক আবহাওয়া এবং বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, যা কারো জন্যেই মঙ্গলময় হবে না। লেকক: ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক-বিশ্লেষক।