করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। কমছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে। প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা নিয়েও।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দুদকে ১৮ হাজার ১৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ৮৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে কমিশন, যা মোট জমা হওয়া অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এসব অভিযোগের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে ৩ হাজার ৬০টি অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ১৪ হাজার ১১৯টি অভিযোগ কোনো কার্যক্রমের জন্য সুপারিশ করা হয়নি। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। চলতি বছর দুদকে আসা মোট অভিযোগ থেকে মাত্র সাড়ে চার শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়েছে। দুদকের এখতিয়ারবহির্ভূত মর্মে মোট অভিযোগের ৭৮ শতাংশই ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দুদকে মোট ১১ হাজার ৮২৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। ২০২০ সালে একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৮৯। ২০২২ সালে গড়ে দুদকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৬৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৫৪১ ও ১ হাজার ১৮৩টি। অভিযোগের তুলনায় অনুসন্ধান কম হওয়ার কারণ জানিয়ে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, যে পরিমাণ অভিযোগ এসেছে তার বেশিরভাগই অসুসন্ধানের জন্য নিতে পারি না। কারণ, যেসব অভিযোগ আসে তার বড় অংশই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। দুদকের সেসব অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার নেই। তফসিলভুক্ত না হলে আমরা অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারি না।
তিনি বলেন, দুদক বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যেসব অভিযোগ গ্রহণ করে তা অনেক সময় অসম্পূর্ণ থাকে। কমিশনে যে কয়টি সোর্সের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ করা হয় তার একটি সরাসরি বা ডাকযোগে আসা অভিযোগ। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদ অভিযোগ হিসেবে নেওয়া হয়। কমিশন অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা পেলে তা অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ মাসে দুদক ৩৫৪টি অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩১২টি অভিযোগ, সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি ৮৯টির, এফআইআর ২৭৬টি, চার্জশিট ১৬২টি আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে ৭৮টি অভিযোগের। দুদকে বর্তমানে অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮টি অভিযোগ। চলমান মামলা আছে ১ হাজার ৬৯৯টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলা আছে যথাক্রমে ৭২৪ ও ১৫৭টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলার শতকরা হার ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থপাচার, ব্যাংক-বিমা সংক্রান্ত অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব অনুসন্ধান ও মামলা চলছে।
বছরজুড়ে আলোচনায় পিকে হালদার, সম্রাটের জামিন: ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার ও তার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে দুদক। চলতি বছরের ১৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভারতের অর্থসংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেফতার হন পিকে হালদার। অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে কলকাতায় তার বিচার চলমান।
গত মে মাসে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, পিকে হালদারকে আইনের মুখোমুখি করতে যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। এক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করা হবে না। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে দু’দেশের বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় ফেরত আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে বছর প্রায় পেরিয়ে গেলেও এখনো পিকে হালদারকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারেনি কমিশন।
এছাড়া গত মে মাসে দুদকের করা অবৈধ সম্পদের মামলায় জামিন পান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্রাটের নামে মামলা করেন।
আদালতে রোষানলে দুদক: ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুদক আইনের অধীনে সংস্থাটির যাত্রা শুরু। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দুদকের রূপকল্প ও লক্ষ্যে বলা হয়েছে, সমাজের সব স্তরে প্রবাহমান একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা এবং এর প্রসার সুনিশ্চিত করা দুদকের উদ্দেশ্য। আর লক্ষ্য হলো, অব্যাহতভাবে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ। তবে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা, চুনোপুঁটি আসামিদের পেছনে বেশি সময় ব্যয়- এমন কর্মকা-ে আদালতে ভর্ৎসনার শিকার হয় কমিশন। গত ২৯ নভেম্বর বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের তিন মামলায় এক আসামির জামিন শুনানিতে দুদক কেন নীরব, তা জানতে চান হাইকোর্ট। বেসরকারি ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ আলীর জামিনের ওপর শুনানিতে এ প্রশ্ন করেন হাইকোর্ট।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত প্রশ্ন করেন, সাত বছরেও তদন্ত কেন শেষ হলো না? বলা হচ্ছে, প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। সব আলামত শনাক্ত করা সময়সাধ্য ও সাক্ষীদের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কথাগুলো আপত্তিকর। দুদক যদি এসব কথা বলে, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? ড্রামা দেখার মতো। আমরা সবাই দেখছি ড্রামা হয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাবে, দুদক চেয়ে চেয়ে দেখবে?
গত ২৭ নভেম্বর অর্থশালীরা পাওয়ারফুল (শক্তিশালী)। তারা বিচারের ঊর্ধ্বে কিংবা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে কি না- দুদকের প্রতি এমন প্রশ্ন রাখেন উচ্চ আদালত। দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, আপনারা ধরছেন চুনোপুঁটি। তাহলে রাঘববোয়ালদের ধরবে কে? সবশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’র ১ থেকে ২৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে কোনো অভিযোগ আগে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
শরীফকা-ে বিব্রত দুদক: বিধিমালা ভঙ্গসহ একাধিক অভিযোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনার প্রতিবাদে প্রথমবারের মতো মানববন্ধন করেন ঢাকাসহ ২১ জেলার দুদক কর্মকর্তারা।
ওইদিন জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন দাবি করেন, দুদকের বিধিমালা ভঙ্গ করায় শরীফের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও ৭ থেকে ১০টি অভিযোগ থাকলেও তা জনসম্মুখে বলা সম্ভব নয়।
এ ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রাঘবোয়ালদের বিরুদ্ধে অভিযান ও অনুসন্ধান পরিচালনা করায় শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে দুদক।
শরীফ তার মেয়াদকালে বিভিন্ন খাতে অনিয়ম অনুসন্ধান ও খবর প্রকাশের জন্য আলোচিত হন। সে সময় তিনি নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা, কর্মচারী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইয়াবা চোরাকারবারি, রোহিঙ্গা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি মামলা করেন।
শরীফকে চাকরিচ্যুত করার চারদিন পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ জানান দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশিকা অনুসরণ না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাজ করা, অনেক ব্যক্তিকে হয়রানি, মামলার ভুক্তভোগীদের প্রহার ইত্যাদি। তবে সেসব অভিযোগের জবাব দিয়ে জাগো নিউজের কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন শরীফ উদ্দিন। এরপর নিজের চাকরি ফিরে পেতে দুদকে আবেদন করলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি।
আইনি সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকা দুদক চায় ঘুরে দাঁড়াতে: গত ২১ নভেম্বর দুদকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক অর্থপাচারের ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে এ বিষয়ে দুদকের কর্মপরিকল্পনা জানতে চান। জবাবে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক বলেন, অর্থপাচার হচ্ছে, এটা সত্যি। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু অর্থপাচারের ব্যাপারে আমাদের (দুদক) তফসিল থেকে সব নিয়ে গেছে আইন করে। এখন আমাদের যেটা আছে মাত্র একটা তফসিলভুক্ত, সেটা নিয়েই আমরা ফাইট করছি।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত অন্য এক প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, অর্থপাচার আইনের ২৭টি অপরাধের মধ্যে শুধু একটি অপরাধ দুদকের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে আইনি সীমাবদ্ধতা দুদকের জন্য বড় জটিলতা। তিনি বলেন, শুল্ক, কর, পুঁজিবাজার, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল-দস্তাবেজ তৈরি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থপাচার বেশি হয়। এসব অপরাধ যেন দুদক তদন্ত করতে পারে, সেজন্য কমিশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। নতুন বছরে মামলা জট কমানো ও দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও মনোযোগী হতে চায় দুদক। সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আগামী বছর (২০২৩ সাল) দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম বাড়াবে দুদক। সততা সংঘের সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ স্বীকৃতি ও বেশ কয়েকটি জেলায় গণশুনানির আয়োজন করা হবে।-জাগোনিউজ২৪.কম