শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পূর্বাহ্ন

আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

গতকাল ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে তেমন কোনও তথ্য উপাত্ত নেই। সম্প্রতি রিস্ক ফ্যাক্টর অব সুইসাইড নামে একটি সার্ভে হয়েছে, এবং প্রাথমিকভাবে এর কাজও শেষ। তার ফলাফল ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল গত জুন মাসে। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের প্রথম দিকে সেই ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
তবে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুইসাইডের হার করোনাকালে বেড়েছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতা এবং আত্মহত্যা বাড়ছে। সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সবাই মিলে একসঙ্গে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করবো’। আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। তথ্য বলছে করোনাকালে দেশে আত্মহত্যার হার বেড়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা শুধু চিকিৎসক বা নির্দিষ্ট কারও কাজ নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
গত ৪ মে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কনস্টেবল তোফাজ্জল হোসেন করোনা আতঙ্কে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তার পরিবারের অভিযোগ। খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে জানান, তোফাজ্জল হোসেন কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। এরপর তিনি করোনায় আক্রান্ত কিনা তার পরীক্ষা করেন। কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। এ নিয়ে মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন বলে তার স্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন।
১৯ জুন রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) প্রশিক্ষণে থাকা ফরহাদ হোসেনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, ফরহাদ আত্মহত্যা করেছেন বলেই তাদের ধারণা। পরদিন রাজধানীর আদাবরে মুগদা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা করোনা পজিটিভ আব্দুল মান্নানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের ধারণা। গাইবান্ধায় করোনা সন্দেহে বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন জাহিদুল ইসলাম। ঢাকা থেকে জ্বর-সর্দিসহ বাড়ি ফিরলে তাকে করোনা রোগী বলে সন্দেহ করে এলাকাবাসী।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা লরনা ব্রিন নামের এক চিকিৎসক আত্মহত্যা করেন। তার বাবা-মা জানান, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে ট্রমায় ভুগছিলেন তাদের মেয়ে। ২৬ এপ্রিল নিজের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে আত্মহত্যা করেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি এ তথ্য জানায়। ৪৯ বছর বয়সী লরনা ব্রিন ম্যানহাটনে অবস্থিত ‘নিউ ইয়র্ক-প্রেসবিটেরিয়ান অ্যালেন হাসপাতাল’-এ জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০ শয্যার ওই হাসপাতালে বহু রোগী মারা যান। পরিবারের দাবি, করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে হতাশায় ছিলেন লরনা। তার বাবা ফিলিপ ব্রিন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, শেষবার মেয়ের সঙ্গে যখন কথা বলেন তখন তাকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন লাগছিল। কীভাবে কোভিড-১৯ রোগীরা মারা যাচ্ছেন, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর আগেই তাদের মৃত্যু হচ্ছে, মেয়ে তাকে এসব বলছিলেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী চিকিৎসক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে গত ছয় মাসে বুলিংয়ের শিকার হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যখন মানবিক বিপর্যয় হয় এবং মানুষ আর্থসামাজিকসহ নানা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যায় তখন আত্মহত্যার মতো বিষয়গুলো বেড়ে যায়। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল-এর অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে আত্মহত্যার হার ১০ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনা। সে লক্ষ্যে আমাদের যেতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে টিনএজার, তরুণ এবং নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ফলে এই ভালনারেবল গ্রুপটিকে যতেœর সঙ্গে দেখাশোনা করা, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, প্রভৃতি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যারা আত্মহত্যা করে তারা আগে থেকেই কোনও না কোনোভাবে কাছের মানুষ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু আমরা সেগুলো বোঝার চেষ্টা করি না, বুঝতে পারি না অথবা সিরিয়াসলি নিই না। বরং সে ইঙ্গিত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করি।
তিনি আরও বলেন, কেউ মৃত্যুর ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করলে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে হবে, কাজ করতে হবে। তার কথা শুনতে হবে, কেউ তার সঙ্গে রয়েছে, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার জীবনটা মূল্যবান−এ বিষয়গুলো বোঝাতে হবে। প্রতিটি মানুষ যেন বুঝতে পারে তার জীবনটা অমূল্য, তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুইসাইডের আরেকটি কারণ মানসিক রোগ। ডিপ্রেশনে মানুষ সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে। ডিপ্রেশন, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া−এই রোগগুলোকে যদি দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা যায় তাহলেও আত্মহত্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
তার মধ্যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার আরেকটি কারণ পারিবারিক নির্যাতন এবং যৌতুক। এর প্রভাবে গ্রামে এখনও অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এটা দূর করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি এবং পরিবারে তার মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ ১৮টি থানায় আত্মহত্যা নিয়ে একটি স্টাডি করে। জরিপের ফলাফল নিয়ে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণের মধ্যে শতকরা ৬১ শতাংশই আত্মহত্যা। এমনকি করোনা হয়েছে এটা জানার পর আত্মহত্যা করেছেন এমন ঘটনাও পেয়েছেন তারা। আর এই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বেশিরভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। ডা. নাশরাত জাবীন বলেন, ৮০ শতাংশ ভিকটিম ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। এরমধ্যে দুই তৃতীয়াংশই নারী। যদিও বলা হয় বিশ্বব্যাপী পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি কিন্তু এই হাসপাতালে আসা তথ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। যা অ্যালার্মিং মন্তব্য করে ডা. জাবীন বলেন, তাদের জীবনে যে কোনও ধরনের ভায়োলেন্স এবং ডিপ্রেসিভ ইলনেস ছিল।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com