রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২০ অপরাহ্ন

মানবাধিকার রক্ষায় আরো আন্তরিক হতে হবে

খবরপত্র ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৩

আগামী বছর সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সমমনা দলগুলো নিয়ে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাকিদ দিচ্ছে। এ ব্যাপারে তাদের তৎপরতা ক্রমবর্ধমান। একই সঙ্গে এই সব দেশ এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে তারা সোচ্চার। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা এখনো প্রত্যাহার করেনি। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা অনেক কমেছিল। সাম্প্রতিকালে আবার বেড়েছে। এটা উদ্বেগজনক দুই দিক দিয়ে। প্রথমত এ ধরনের হত্যাকা- মানুষকে ভীত ও আতংকগ্রস্ত করে, অসহায় ও হতাশ করে। দ্বিতীয়ত বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মতো আরো নিষেধাজ্ঞার আশংকা বাড়িয়ে তোলে। কোনো ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নেয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। কাজেই, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উপেক্ষা করা বা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। লংঘন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। মানুষের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, মানবিক, সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার লংঘিত হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে সরকারকে এবং সরকারকেই এসব অধিকারের নিশ্চিত সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুবিচার কায়েম করতে হবে।
বিদায়ী ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বিভীষিকাময় বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনটির ওপর নজর দিলেই এর সত্যতা প্রতীয়মান হবে। প্রতিবেদন মতে, দেশে ওই বছর ৪৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৭০ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৬৯১৪ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ১৯ জন, আইনশৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছে ১৫ জন। অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছে ৫ জন। নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৬৯৪টি। নারী খুন হয়েছে ১২৬ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৩৬ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ১২টি। শিশু নির্যাতীত হয়েছে ১০৪৫ জন, যার মধ্যে নিহত হয়েছে ৪৭৪ জন। এছাড়া সীমান্ত হত্যার শিকার হয়েছে ২১ জন। গণপিটুনির শিকার হয়েছে ৩৬ জন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ১২টি। একই সময়ে ২১০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২২৪৯টি মামলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, মানবাধিকার রক্ষা বা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। লক্ষ করার বিষয়, অধিকাংশ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে রাষ্ট্রের তরফে বা রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা। এছাড়া এমন কিছু আইন আছে, যা নির্যাতন-হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে নাগরিকরা খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি অপরাধ করে, যা মানবাধিকার লংঘনের শামিল। সরকার যদি মানবাধিকার সুরক্ষায় সতর্ক ও অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে, মানবাধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন না করে কিংবা এ ধরনের আইন থাকলে বাতিল করে এবং আইনশৃংখলা বাহিনীকে আইনের অপপ্রয়োগ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা নিশ্চিত করে, তবে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কমে আসতে পারে। আইনের শাসন এবং অপরাধীদের ত্বরিত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে নাগরিক পর্যায়ের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাও কমে যেতে পারে।
অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকারের দমন-পীড়ন রাজনৈতিক হানাহানি, সহিংসতা ও খুন-খারাবির প্রধান কারণ। গণতন্ত্র না থাকা এর জন্য দায়ী। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও মূল্যবোধের চর্চা দীর্ঘদিন ধরে দেশে অনুপস্থিত। গণতন্ত্র চর্চার একটা অপরিহার্য দিক হলো নির্বাচন। সরকারের শান্তিপূর্ণ পালাবদল নিশ্চিত করার জন্য সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। সেই নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ। বিগত দুই সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য হয়নি। ক্ষমতাসীন দল ও সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এহেন অগণতান্ত্রিক পথ-পন্থা নেই, যা ওই দুই নির্বাচনে অনুসরণ করেনি। দেশে-বিদেশে কোথাও ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। সরকার আইনশৃংখলা বাহিনী ও দলীয় পেশীশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীতি নিয়েছে। এজন্য ক্ষমতা প্রত্যাশী বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা ও গ্রেফতার অভিযান চালাতে এতটুকু কার্পণ্য করছে না। রাজনৈতিক সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হবে না ততদিন, যতদিন না রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে। একই কারণে গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- থামবে না। পর্যবেক্ষকদের আশংকা, নির্বাচনের বছরে এসব ঘটনা আরো বেশি বেশি ঘটতে পারে। যখন গণতন্ত্র না থাকে, আইনের শাসনের কমতি থাকে, তখন নাগরিক পর্যায়ে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ক্ষমতাবানদের ছত্রচ্ছায়ায় বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত হয়। বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়ন কাজ যথেষ্টই হয়েছে। অবকাঠামোসহ বিদ্যুৎ, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ কিছু মাইলফলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্প দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সরকারের এসব কীর্তি ও অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বহাল থাকায়।
আমরা আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মানবাধিকার রক্ষায় আরো আন্তরিকতার পরিচয় দিবে। কারণ তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর নির্ভর করছে সরকার ও দেশের ভাবমর্যাদা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com