যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু ভারত সফর শেষ করে শনিবার বাংলাদেশে আসছেন। মার্কিন এই কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরকে অনেকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছেন। এর একটি বড় কারণ হলো- একদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রশ্ন তুলছে, তখনই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়েও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডোনাল্ড লু সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করবে।
লু এমন এক সময়ে ঢাকা সফরে আসছেন যখন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের নানা তৎপরতা নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি
রয়েছে। লু’র সফর শুরু হবার কয়েকদিন আগেই ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়- এই সফরের সময় লু জ্বালানি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শ্রম এবং মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আলোচনার সময় তারা র?্যাবের ওপর থেকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞ তুলে নেবার জন্য জোরালো দাবি তুলে ধরবেন।
সরকার কিভাবে দেখছে? ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে বাংলাদেশ সরকার যে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি বোঝা যায়। গত ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সে বৈঠকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ডোনাল্ড লু’র সফরের বিষয়টি উঠে আসে এবং ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা হয়।
মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে সবাই যাতে একই সুরে কথা বলে সে বিষয়টিও উঠে আসে। এছাড়া গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ রোধে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যদিও বলছেন এই সফরকে তারা নিয়মিত বিষয় হিসেবেই দেখছেন। গত বুধবার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ডোনাল্ড লু’র সফরের সময় শুধু যে নির্বাচন এবং মানবাধিকার বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে- তা নয়। ‘তাদের কাছে আমাদের চাওয়ার বেশ কিছু জায়গা আছে এবং তাদেরও হয়তো কিছু এক্সপেকটেশন আছে’ বলেন পররাষ্ট্র সচিব। সব বিষয় নিয়ে ‘খোলামেলা’ আলোচনা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এমন কথাও বলছেন যে, একজন কূটনীতিকের নিয়মিত সফরকে অনেকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। গত ৯ জানুয়ারি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন যে, ‘বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বেসি বা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অ্যাম্বেসিতে যদি একটা পাতাও নড়ে অনেকে এটাকে ফলো করবে যে, পাতাটা কেন নড়ছে? তবে এটাতে এতো ওভার-এনথুজিয়াস্ট হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।’
বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘ঠিকঠাক আছে’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মাঝে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার কারণে র?্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তবে তারা এখন এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
লু-র সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে যে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়ে রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষকরে গত ডিসেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানীর শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় গেলে সেখানে তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টার পর নানা ঘটনায় এর আভাস পাওয়া যায়। ওই ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে দেখা করেছিলেন। এছাড়া গত ১৫ই ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সাথে আলোচনা হয় দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র। সেখানে শাহীনবাগের ঘটনার জন্য পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। এই ঘটনার পর গত ৭ই জানুয়ারি চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লবাখার। তার সফরের পর এ সপ্তাহেই আসছেন ডোনাল্ড লু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, মার্কিন এই দুই কর্মকর্তার প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই দুটো জায়গাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি লেভেল।’ তার মতে, আইলিন লবাখার এর সফরে তিনি মূলত সরাসরি দেখে, বুঝেশুনে তারপর একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আর ডোনাল্ড লু সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, ‘তিনি (লু) এখন সেটি পলিটিক্যালি সাজাবেন।’ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে এখন কোন দিকে যাওয়া দরকার বা কী করা দরকার সে বিষয়ে পরামর্শ তৈরিতে ভূমিকা পালন করবেন লু। সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড লু একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত। কৌশলগত নানা দিক ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং বাসিন্দাদের সাথেও সম্পর্কের বিষয়গুলো রয়েছে। এসব বিষয়গুলোর মধ্যে গভর্নেন্স ইস্যু বা রাষ্ট্র পরিচালনা- এটি বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে একটি উপাদান মাত্র। যদিও এর মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনের মতো বড় বিষয় রয়েছে।
কবিরের মতে, শাহীনবাগের ঘটনা নিয়ে দুই দেশই বেশ সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে স্পষ্টভাবে তাদের মতো জানিয়েছে এবং বাংলাদেশে পররাষ্ট্র দফতরেও জানানো হয়েছে। তাই এই বিষয়টি ডোনাল্ড লু’র সফরে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে না বলে মনে করেন তিনি।
‘মানবাধিকারের যে জায়গাগুলোতে জটিলতা আছে সেগুলো নিয়ে তারা আমাদের সাথে কথা বলবে, আমাদের কাছ থেকে হয়তো তারা প্রতিশ্রুতি চাইবে,’ বলেন তিনি।
কী বলছে মার্কিন দূতাবাস? ডোনাল্ড লু এর সফরের বিষয়ে বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে এ বিষয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, জ্বালানি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শ্রম এবং মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করবেন লু। সফরের সময় বাংলাদেশের উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও সুশীল সমাজের সাথে সাক্ষাৎ করবেন তিনি। এ সময় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ের প্রসার ঘটানো নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, এছাড়া শ্রম এবং মানবাধিকার নিয়ে সরকার ও সুশীল সমাজের কাছ থেকে তাদের নিজস্ব মতামত শুনবেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি