বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ভারত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান কখনো ভুলে যাবার নয়। সেই থেকে শুরু দুই দেশের বন্ধুত্বের পথচলা। দিনে দিনে দ্বিপাক্ষিক এ সম্পর্কের পরিধি বেড়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের ডানা বিস্তৃত হয়েছে নানা আঙ্গিকে। চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে শুরু করে ভারতের পর্যটন এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দিনে দিনে প্রসারিত হয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্বের এ সুফল নাগরিকরাও ভোগ করছে সমানতালে। তারই ফলশ্রুতিতে সদ্য সমাপ্ত ২০২২ সালে চিকিৎসা, ভ্রমণ, শিক্ষাসহ নানা প্রয়োজনে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দিয়েছে ভারত। এসব ভিসা পেতে শুধুমাত্র প্রসেসিং ফি ছাড়া আর কোনো খরচ করতে হয়নি বাংলাদেশিদের। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির এই সেবা দিতে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভিসা সেন্টার স্থাপন করেছে ভারত। বাংলাদেশে বিশ্বের বৃহত্তম ভিসা অপারেশন নেটওয়ার্ক ভারতের। দেশটি সবচেয়ে বেশি ভিসা বাংলাদেশি নাগরিকদের দিচ্ছে বলে দাবি ভারতীয় হাইকমিশন সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশি নাগরিকরা স্থল, নৌ কিংবা আকাশ পথে ভারতে যেয়ে থাকেন। অনেকে হেঁটেও ভারতে যেতে পারেন চট্টগ্রামের সন্তান জাবেদ চৌধুরী। ভারতের কলকাতার ব্রেনওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিরিয়ারিং (সিএসই) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি। পড়াশোনার জন্য ৫ বছরে অসংখ্যবার ভারতে যাওয়া-আসা করতে হয়েছে জাবেদকে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় যে ব্যয়, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম ভারতে। পড়াশোনার জন্য আমাকে দীর্ঘসময় ভারতে থাকতে হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ থেকে কখনো ফ্লাইটে, কখনো বাসে কলকাতা গিয়েছি। অধিকাংশ সময়ে অনলাইনে ভিসা আবেদন করেছি। যথাসময়ে ভিসা পেয়েছি। তবে যারা ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন, তাদের কিছুটা ঝক্কি পোহাতে হয়। ইমিগ্রেশনে আমাদের দেশে সময় লাগলেও ভারতীয় প্রান্তে অনেক কম সময় ব্যয় হয়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত চট্টগ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক আজাদ তালুকদার। চিকিৎসার জন্য গত দুই বছরে অসংখ্যবার ভারতে যেতে হয়েছে তাকে। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে জাগো নিউজকে আজাদ বলেন, চিকিৎসা, পড়াশোনা, ভ্রমণসহ নানা কারণে বাংলাদেশিদের কাছে অন্যতম পছন্দের জায়গা ভারত। যে কারণে প্রতিদিনই বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় দূতাবাস এবং উপ-দূতাবাসগুলোতে ভিসার জন্য ভিড় বাড়ছে। তবে সম্প্রতি ভিসা প্রত্যাশী সবার সশরীরে উপস্থিতি এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাধ্যতামূলক করায় রোগীদের কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এই জটিলতার কারণে মুমূর্ষু রোগীদের অনেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পারছেন না। অথচ আগে রোগীদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস নিয়ে তার অ্যাটেনডেন্ট ভিসার আবেদন জমা দিতে পারতেন। এ অবস্থায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও সংকটাপন্ন রোগীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি-পরিবেশ ও বহু ধর্ম-বর্ণের দেশ ভারত। ভারত এমন একটি দেশ, যেটি পুরো ভ্রমণ করলে পুরো বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমাকে মাঝেমধ্যে ভারতে যেতে হয়। আমাদের দেশে পর্যটন সুবিধার চেয়ে ভারতে সুবিধা অনেক বেশি। তাদের (ভারতের) চিকিৎসা সেবা নির্ভরযোগ্য। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। ভারতে ভিসা প্রদান পদ্ধতি আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে। এখন অনলাইনে ভিসা আবেদন করা যায়। অনলাইনেই মেলে সাক্ষাতের সময়। এর ফলে অনেক ভোগান্তি কমে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি) রয়েছে ১৫টি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র। বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বিশ্বের বৃহত্তম ভিসা অপারেশন নেটওয়ার্ক ভারতের। দেশটি সবচেয়ে বেশি ভিসা বাংলাদেশি নাগরিকদের দিচ্ছে বলে দাবি ভারতীয় হাইকমিশন সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশি নাগরিকরা স্থল, নৌ কিংবা আকাশ পথে ভারতে যেয়ে থাকেন। অনেকে হেঁটেও ভারতে যেতে পারেন।
মূলত বাংলাদেশের চারিদিকে বিস্তৃত সীমান্ত থাকায় স্থলবন্দর ব্যবহার করে আশপাশের জেলা-উপজেলার বাসিন্দারা হেঁটে ভারতে প্রবেশের সুবিধা নিয়ে থাকেন। স্থলপথে হেঁটে বাদেও বাসে ও ট্রেনে করে ভারতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশেও আসা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোভিড পরিস্থিতিতে ভিসা প্রদানে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ধীরে ধীরে এসব শর্ত শিথিল করছে ভারত। করোনা অতিমারির আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের ১৬ লাখেরও বেশি ভিসা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকাস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী লকডাউনেও জরুরি পরিস্থিতিতে ভিসা প্রদান বন্ধ করেনি ভারত। ওই বছর প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশিকে ভিসা দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে এক লাখ ৯৬ হাজার মেডিকেল ভিসা।
অনলাইনে যথাযথ ডকুমেন্টস দেওয়া হলে সহজেই ভারতের ভিসা পাওয়া যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিসাপ্রার্থীরা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ হন। দেখা যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা একই ডকুমেন্ট একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংযুক্ত করে দিচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে ভিসা পেতে জটিলতা পোহাতে হয় তবে ২০২২ সালে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি ভিসা দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের মার্চের শেষের দিক থেকে স্থলবন্দর ব্যবহারে কোভিডকালীন বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। এ কারণে ভিসার আবেদন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশে ১৫টি আবেদন কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ১১ লাখ ভিসা ইস্যু করে ভারত। বছর শেষে এ সংখ্যা প্রায় ১২ লাখের কাছাকাছি পৌঁছায়। এদের প্রায় তিন লাখ মেডিকেল ভিসা। ভারতীয় ভিসা আবেদনের জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভিসা সেন্টার রয়েছে রাজধানী ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কে। ঢাকাস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের ডেপুটি চিফ অপারেটিং অফিসার কিংশুক মিত্র বলেন, ভিসাপ্রার্থীরা অনলাইনে আবেদন করেন। যথাযথ ডকুমেন্টস দেওয়া হলে নিশ্চিতভাবে ভিসা দেওয়া হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিসাপ্রার্থীরা মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ হন। দেখা যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা একই ডকুমেন্ট একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংযুক্ত করে দিচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে ভিসা দেওয়াটা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য। সেজন্য যে কেউ অনলাইনে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দিলে বিড়ম্বনা কিংবা হয়রানিমুক্তভাবে যথাসময়ে ভিসা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশিদের জন্য ভারত বিনামূল্যে এসব ভিসা দিয়ে থাকে। তবে ভিসা আবেদনে প্রসেসিং ফি হিসেবে ৮০০ টাকা নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।