‘সে সফলকাম হয়েছে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে তারপর সালাত পড়েছে।’ (সূরা আলা : ১৪-১৫) ‘নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরা।’ (সূরা মুমিনুন : ১)
মূল শব্দ ‘ফালাহ’। ফালাহ মানে সাফল্য ও সমৃদ্ধি। এটি ক্ষতি, ঘাটতি, লোকসান ও ব্যর্থতার বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। সফলতা বলতে পার্থিব সমৃদ্ধি বুঝানো হয়নি বরং আসল ও সত্যিকার সফলতা বলতে কুফরি ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা। এর সাথে পার্থিব সফলতা সমৃদ্ধি অর্জিত হোক বা না হোক তাতে কিছু আসে যায় না। সূরা মুমিনুনের আয়াতটি যখন নাজিল হয় তখন এক দিকে ছিল ইসলামী দাওয়াত বিরোধী সরদারবৃন্দ। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতির পর্যায়ে ছিল। তাদের কাছে ছিল প্রচুর ধন-দৌলত।
বৈষয়িক সমৃদ্ধির যাবতীয় উপাদান তাদের হাতের মুঠোয় ছিল। আর অন্য দিকে ছিল ইসলামী দাওয়াতের অনুসারীরা। তাদের অধিকাংশ তো আগে থেকেই ছিল গরিব ও দুর্দশাগ্রস্ত। কয়েকজনের অবস্থা সচ্ছল থাকলেও অথবা কাজ কারবারের ক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই সফলকাম থাকলেও সর্বব্যাপী বিরোধিতার কারণে তাদের অবস্থাও তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় যখন ‘নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরা’ নাজিল হয় তখন এ থেকে আপনা আপনি এ অর্থ বের হয়ে এসেছে যে, কাফেরদের সাফল্য ও ক্ষতির মানদ- ভুল, তাদের অনুমান ত্রুটিপূর্ণ, তাদের দৃষ্টি দূরপ্রসারী নয়, তাদের নিজেদের যে সাময়িক ও সীমিত সমৃদ্ধিকে সাফল্য মনে করে তা আসলে সাফল্য নয়, তা হচ্ছে ক্ষতি এবং মুহাম্মদ সা:-এর অনুসারীদের তারা যে ব্যর্থ ও অসফল মনে করছে, আসলে মুমিনরাই সফল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিঃসন্দেহে অপরাধী কোনো দিন সফলকাম হতে পারে না। (সূরা ইউনুস : ১৭)
আসলে অজ্ঞ লোকেরা সফলকাম বলতে দীর্ঘ বা বৈষয়িক সমৃদ্ধি অথবা পার্থিব উন্নতি অর্থ গ্রহণ করে। তারা কুরআনি পরিভাষায় সফলকাম অর্থ জানে না এবং অবকাশ দানের বিধান সম্পর্কেও জ্ঞাত নয়। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ অপরাধীদের জন্য এ বিধান নির্ধারিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা কি মনে করে, আমি যে তাদের অর্থ ও সন্তান দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছি, তা দ্বারা আমি তাদের কল্যাণদানে তৎপর রয়েছি? না, আসল ব্যাপার সম্পর্কে তাদের কোনো চেতনাই নেই। আসলে কল্যাণের দিকে দৌড়ে যাওয়া ও অগ্রসর হয়ে তা অর্জনকারী লোক তো তারাই যারা নিজেদের রবের ভয়ে ভীত।’ (সূরা মুমিনুন : ৫৫-৫৭) সূরা মুমিনুনের ৫৭ আয়াত অনুযায়ী সফলকাম তারাই দুনিয়ায় যারা আল্লাহর ব্যাপারে ভীতিশূন্য ও চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করে না। আল্লাহ সম্পর্কে তারা নির্ভীক হয় না। যা মনে আসে তাই করে না এবং উপরে একজন আল্লাহ আছেন তিনি জুলুম ও বাড়াবাড়ি করলে পাকড়াও করেন এ কথা কখনো ভুলে যায় না। বরং তাদের মন সবসময় তাঁর ভয়ে ভীত থাকে এবং তিনিই তাদের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে থাকেন। কুরআনের উল্লেখিত আয়াতসমূহের মর্মার্থ অনুযায়ী নি¤œ লিখিতরাই সত্যিকার অর্থে সফলকাম।
যারাই কুরআন ও মুহাম্মদ সা:-এর কথা মেনে নিয়ে এ গুণাবলি নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করবে এবং এ নীতির অনুসারী হবে তারা যে কোনো দেশ, জাতি ও গোত্রের হোক না কেন অবশ্যই তারা দুনিয়ায় ও আখিরাতে সফলকাম হবে। সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষণা অথবা নিছক সৎচরিত্র ও সৎকাজের ফল নয়। বরং উভয়ের সম্মিলনের ফল। মানুষ যখন আল্লাহর পাঠানো পথনির্দেশ মেনে চলে এবং তারপর সে অনুযায়ী নিজের মধ্যে উন্নত নৈতিকতা ও সৎকর্মশীলতা সৃষ্টি করে সে সফলতা লাভ করে।
নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। বরং তা একটি ব্যাপকতর কল্যাণকর অবস্থার নাম। দুনিয়ার ও আখিরাতে স্থায়ী সাফল্য ও পরিতৃপ্তিকেই এ নাম অভিহিত করা হয়। এটি ঈমান ও সৎকর্ম ছাড়া অর্জিত হয় না। পথভ্রষ্টদের সাময়িক সমৃদ্ধি ও সাফল্য এবং সৎ মুমিনদের সাময়িক বিপদ আপদকে এ নীতির সাথে সাংঘর্ষিক গণ্য করা যেতে পারে না।
সূরা মুমিনুন-এর শুরুর আয়াতে সফলতার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে একই সূরার ৫৫-৫৭ আয়াতে সেই একই বিষয়বস্তুকে আবার ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা ‘কল্যাণ’ ‘ভালো’ ও ‘সমৃদ্ধি’র একটি বস্তুবাদী ধারণা রাখত। তাদের মতে, যে ব্যক্তি ভালো খাবার, ভালো পোশাক ও ভালো ঘরবাড়ি লাভ করেছে, যাদের ব্যবসাবাণিজ্য উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে, যাকে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করা হয়েছে এবং সমাজে যে খ্যাতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করতে পেরেছে সে সাফল্য লাভ করছে। আর যে ব্যক্তি এসব থেকে বি ত হয়েছে সে ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ মৌলিক বিভ্রান্তির ফলে তারা আবার এর চেয়ে অনেক বড় আরো একটি বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। সেটি ছিল এই যে, এ অর্থে যে ব্যক্তি কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করেছে সে নিশ্চয়ই সঠিক পথে রয়েছে বরং সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, নয়তো এসব সাফল্য লাভ করা তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব হলো। পক্ষান্তরে এ সাফল্য থেকে বি ত দেখছি তারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে ভুল পথে রয়েছে এবং আল্লাহর গজবের শিকার হয়েছে। এ বিভ্রান্তিরটি আসলে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী লোকদের ভ্রষ্টতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্যতম।
এ ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য রয়েছে যেগুলো ভালোভাবে অনুধাবন না করলে চিন্তা ও মন-মানস কখনোই পরিচ্ছন্ন হতে পারে না।
এক. মানুষের ‘সাফল্য’ কে কোনো ব্যক্তি, দল বা জাতির নিছক বস্তুবাদী সমৃদ্ধি ও সাময়িক সাফল্য অর্থে গ্রহণ করার চাইতে তা অনেক বেশি ব্যাপক ও উন্নত পর্যায়ের জিনিস।
দুই. সাফল্যকে এ সীমিত অর্থে গ্রহণ করার পর যদি তাকেই সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের মানদ- গণ্য করা হয় তাহলে এমন একটি মৌলিক ভ্রষ্টতায় পরিণত হয় যার মধ্যে থেকে বাইরে বের না হওয়া পর্যন্ত কোনো মানুষ কখনো বিশ্বাস, চিন্তা, নৈতিকতা ও চারিত্রিক ক্ষেত্রে সঠিক পথ লাভ করতেই পারে না।
তিন. দুনিয়াটা আসলে প্রতিদান দেবার জায়গা নয় বরং পরীক্ষাগৃহ। এখানে নৈতিক শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলেও তা বড়ই সীমিত পর্যায়ের ও অসম্পূর্ণ ধরনের। এ সত্যটি এড়িয়ে গিয়ে এ কথা মনে করা যে, এখানে যে ব্যক্তি যে নিয়ামতই লাভ করছে তা লাভ করছে ‘পুরস্কার’ হিসেবেই এবং সেটি লাভ করা পুরস্কার লাভকারীর সত্য, সৎ ও আল্লাহর প্রিয় হওয়ার প্রমাণ আর যার ওপর যে বিপদই আসছে তা হচ্ছে তার ‘শাস্তি’ এবং তা এ কথাই প্রমাণ করছে যে শাস্তি লাভকারী মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে আল্লাহর কাছে অপ্রিয়। আসলে এসব কিছু একটা বিভ্রান্তি বরং নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্ভবত আমাদের সত্য সম্পর্কিত ধারণা ও নৈতিকতার মানদ-কে বিকৃত করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় আর কোনো জিনিস নেই। একজন সত্যসন্ধানীকে প্রথম পদক্ষেপেই এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, এ দুনিয়াটা মূলত একটি পরীক্ষাগৃহ এবং এখানে অসংখ্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যক্তিদের, জাতিদের ও সমগ্র বিশ্বমানবতার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এ পরীক্ষার মাঝখানে লোকেরা যে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয় সেগুলো পুরস্কার ও শাস্তির শেষ পর্যায় নয়। কাজেই সেগুলোকে মতবাদ, চিন্তাধারা, নৈতিকতা ও কর্মকা-ের সঠিক ও বেঠিক হওয়ার মানদ-ে পরিণত করা এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় ও অপ্রিয় হওয়ার আলামত করা যাবে না।
চার. সাফল্যের প্রান্ত নিশ্চিতভাবেই সত্য সৎকর্মের সাথে বাঁধা আছে এবং মিথ্যা ও অসৎকর্মের পরিণাম ক্ষতি এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ দুনিয়ায় যেহেতু মিথ্যা ও অসৎকর্মের সাথে সাময়িক ও বাহ্যিক সাফল্য এবং অনুরূপভাবে সত্য ও সৎকর্মের সাথে প্রকাশ্য ও সাময়িক ক্ষতি সম্ভবপর আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জিনিসটি ধোঁকা বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই সত্য-মিথ্যা ও সৎ-অসৎ যাচাই করার জন্য একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র মানদ-ের প্রয়োজন, যার মধ্যে প্রতারণার ভয় থাকবে না। নবীগণের শিক্ষা ও আসমানী কিতাবসমূহ আমাদের এ মানদ- সরবরাহ করে। মানুষের সাধারণ জ্ঞান এর সঠিক হওয়ার সত্যতা বিধান করে এবং মারূফ ও মুনকার তথা সৎ কাজ ও অসৎকাজ সম্পর্কিত মানবজাতির সম্মিলিত মানসিক চিন্তা-অনুভূতি এর সত্যতার সাক্ষ্য দেয়।
পাঁচ. যখন কোনো ব্যক্তি বা জাতি একদিকে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ফাসেকি, অশ্লীল কার্যকলাপ, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করতে থাকে এবং অন্য দিকে তার ওপর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে তখন বুঝতে হবে, বুদ্ধি ও কুরআন উভয় দৃষ্টিতে আল্লাহ তাকে কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন এবং তার ওপর আল্লাহর করুণা নয় বরং তার ক্রোধ চেপে বসেছে। তার ভুলের জন্য দুনিয়াতে যদি শাস্তি এসেই যায় তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তার প্রতি এখনো অনুগ্রহশীল আছেন, তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভুলের জন্য যদি পুরস্কার আসতেই থাকে তবে বুঝতে হবে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়ার ফয়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের আনুগত্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, পরিচ্ছন্ন লেনদেন, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সদাচার, দয়া, স্নেহ, মায়া ও মমতা এবং অন্য দিকে তার প্রতি বিপদ-আপদ ও কাঠিন্যের অবিরাম ধারা বর্ষিত হতে থাকে। আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে, এটি আল্লাহর ক্রোধ নয় বরং তার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহেরই আলামত। স্বর্ণকার স্বর্ণকে খুব বেশি উত্তপ্ত করতে থাকে যাতে তা খুব বেশি ঝকঝকে তকতকে হয়। চূড়ান্ত ও সত্যিকারের সাফল্য তার জন্য অপেক্ষা করছে এবং এটিই সত্যিকারের কুরআনি সফলতা। সূরা মুমিনুন এর ১-৮ এবং নি¤œলিখিত আয়াতে সফল ব্যক্তির কয়েকটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। ‘যারা নিজেদের রবের আয়াতের প্রতি ঈমান আনে। যারা নিজেদের রবের সাথে কাউকে শরিক করে না। এবং যাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যা কিছুই দেয় এমন অবস্থায় দেয় যে, তাদের অন্তর এ চিন্তায় কাঁপতে থাকে যে, তাদের রবের কাছে ফিরে যেতে হবে।’ (সূরা মুমিনুন : ৫৮-৬১)
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট