আজ ১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাতার সংগ্রামের মাস শুরু। বাংলা একাডেমির অমর একুশের বই মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- রক্তে রাঙানো সেই ফেব্রুয়ারি মাস- ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু আজ মঙ্গলবার থেকে। জাতি এই মাসেই নানা আয়োজনে শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্মরণ করে যারা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই ফেব্রুয়ারি মাসই ছিল শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকরা। তাদের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ; অন্যদিকে গৌরবোজ্জ্বল । কারণ পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল এ মাসে। আর তাই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত।
উইকিপিডিয়ায় বর্ণিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিস “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু?” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। সেই সময়ে সরকারি কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, ট্রেনের টিকিটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো। তমদ্দুন মজলিসের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন অধ্যাপক (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল) আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহবান করেন। সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই বছরের নবেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত ‘পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে’ পূর্ব-পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবি জানান।
১৯৪৭ সালের ৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয় এবং ১৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা দেয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙালি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে প্রথমবারের মত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে কিভাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হলো তা বিশ্বের অন্যতম বিরল ঘটনা।
বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি- ফাগুণের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য প্রথম জীবনদান বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে। সেই থেকে শুরু হয়ে যায় বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই। পাকিস্তানিদের সাথে হিসেব-নিকেশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। ৫২ সালে যে আগুন জ্বলেছিল রাজধানী ঢাকা শহরে সে আগুন যেন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে সবখানে। যে আগুন জ্বলেছিল মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে সবখানে সবখানে। বাঙালির বুকের ভেতর জ্বলে উঠা আগুন যেন সহ¯্র বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। যা এসে শেষ হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এ ভাষার মাসেই শহীদদের স্মরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে করোনা মহামারির কারনে এবারের একুশের অনুষ্ঠানমালায় আনা হচ্ছে পরিবর্তন। একুশের মাসের সবচেয়ে বড় কর্মকা- মাস ব্যাপি বইমেলা এবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে না। ইতোমধ্যে মেলা দুইসপ্তাহ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। করোনা মহামারির বাস্তবতা বিবেচনা করে এবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।