ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছিল আওয়ামী লীগ। তিনি জিতেছেন, তবে এই আসনে ভোট পড়েছে ছয়টির মধ্যে সবচেয়ে কম।
যদিও ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনকি এই আসনের কোথাও কোথাও এই হুমকি দেওয়া হয়েছে যে ভোট দিতে না গেলে সরকারি সুবিধা পাওয়া যাবে না।
বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে গত বুধবার ভোট হয়। বেসরকারি ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ, যা আসনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
উল্লেখ্য, গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশের কিছু বেশি। গত বছরের নভেম্বরে ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনেও ২৬ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে।
আওয়ামী লীগের এত চেষ্টার পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে কম ভোট
নির্বাচনের প্রার্থী, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, রাজনীতিসচেতন নাগরিক ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কিছু কারণ জানা গেছে। তাঁরা মনে করেন, সাধারণভাবে উপনির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম থাকে। তার ওপর বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা ভোট দিতে যাননি। এলাকাটিতে বিএনপির সমর্থনভিত্তি শক্তিশালী।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের অনেকেই ভোট দিতে যাননি। কারণ কী, সেটা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতাতে যে দলীয় কৌশল আওয়ামী নিয়েছিল, তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের অনেকের অসন্তোষ ছিল। কেউ কেউ দলের নির্দেশে শুধু প্রকাশ্যে তৎপরতা দেখিয়েছেন।
সাধারণ ভোটারদের কেউ কেউ বলছেন, যাঁরা ভোট দিতে কেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের অনেকে বাইরে এসে বলেছেন, নিজের ভোট নিজে দেওয়া যাচ্ছে না। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) আঙুলের ছাপ মেলানোর পর অন্য লোকেরা ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ও অন্য ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল মামুন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এক হাতে তালি বাজে না। প্রতিপক্ষ সমান সমানে না হলে কোনো সময়ই নির্বাচনে উত্তাপ আসে না। তিনি বলেন, ‘জনগণকে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু প্রার্থীর শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় কোনো উত্তেজনা আসেনি।’
আওয়ামী লীগের তৎপরতা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে উকিল আবদুস সাত্তার ও আবু আসিফ আহমেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার আভাস ছিল শুরু থেকেই। আবু আসিফ আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আশুগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। তবে তিনি গত শুক্রবার থেকে নিখোঁজ। নির্বাচনে তাঁর পক্ষে কোনো তৎপরতা ছিল না। শেষ পর্যন্ত আবদুস সাত্তার ৪৪ হাজার ৯১৬, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. আবদুল হামিদ ৯ হাজার ৬৩৫, আবু আসিফ ৩ হাজার ২৬৯, জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম ১ হাজার ৮১৮ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জিয়াউল হক মৃধা ৪৮৪ ভোট পেয়েছেন।
বিএনপি এই ভোট বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন ও স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে দলের সিদ্ধান্তে তাঁরা সরে দাঁড়ান। পরে আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় সিদ্ধান্তে আবদুস সাত্তারের পক্ষে তৎপরতা শুরু করেন।
নির্বাচনে ভোটার আনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। প্রচারের বিভিন্ন পর্যায়ে উকিল সাত্তার সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে কর্মিসভা, পরামর্শ সভা করা হয়। কর্মিসভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম অংশ নেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন একাধিক দিন সেখানে গিয়ে সভা করেন। তবে তাতে ভোটারদের তেমন আগ্রহ তৈরি করা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত হলো, আবু আসিফ নিখোঁজ হওয়ায় উকিল আবদুস সাত্তারের পথ পরিষ্কার হয়েছে। তাই তিনি সহজে জিতেছেন।
আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলার ছয়জন আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আবদুস সাত্তারের পক্ষে কাজ করতে হবে—দলের এই সিদ্ধান্তের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপনির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দলীয় নেতা-কর্মীদের পরিবারের সদস্যরাই ভোট দিতে কেন্দ্রে যাননি। আর দুই উপজেলায়ই দলের মধ্যে বিভক্তিও প্রভাব ফেলেছে। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহাবাজাপুর ও শাহাজাদাপুর ইউনিয়নে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এখানে আমাদের দলীয় একটি ভোট রয়েছে। সেটিও পড়েনি।’ তিনি আরও বলেন, আসলে ভোটারদের মনের ওপর তো আর জোর খাটানো যায় না। প্রার্থীকে জেতানোর জন্য প্রয়োজনীয় ভোট পাওয়া গেছে। কারণ, অন্য প্রতীকে তেমন ভোট পড়েনি।
অনাগ্রহ আঁচ করতে পেরে ভোটের দিন কোনো কোনো জায়গায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে চাপও দেওয়া হয়। যেমন অরুয়াইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তালেব দুপুর থেকে নিজ গ্রামের মজিদের মাইকে লোকজনকে ভোটকেন্দ্রে আসতে আহ্বান জানাতে থাকেন। অনেক ভোটারকে ভোট দিতে না এলে পরে সরকারি সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। তারপরও ফল পাওয়া যায়নি।
কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য অরবিন্দ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক ভোটারের কাছে গিয়েছিলাম কেন্দ্রে আনার জন্য। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, কিসের ভোট? আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভোটার আনার জন্য, কিন্তু কেউ আসতে চায়নি।’
কলার ছড়া নিয়েও ‘অসন্তোষ’
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে অংশ নিয়ে উকিল আবদুস সাত্তার ৮৩ হাজার ৯৯৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন। তিনি কলার ছড়া প্রতীকে পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ৪১৯ ভোট।
এবারের উপনির্বাচনে শুরুতে সাত্তারকে দেওয়া হয়েছিল ডাব প্রতীক। এলাকায় কলার ছড়ার পরিচিতি থাকায় এক দিন পর সাত্তারের প্রতীক বদল করে কলার ছড়া প্রতীকটি বরাদ্দ করা হয়। এই প্রতীক নিয়েও মঈন উদ্দিনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি তৈরি হয়।
ভোটারদের অনেকে মনে করেন, উকিল আবদুস সাত্তারের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়েছে। কেউ কেউ তাঁর ওপর বিএনপির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার দায় দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, তিনি চার বছর ধরে এলাকার মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরাইল সদর ও আশুগঞ্জ এলাকার ১০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা হয়।
আশুগঞ্জ বাজার এলাকার খলিলুর রহমান, আড়াইসিধার গ্রামের সেলিম মিয়া ও চরচারতলার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আবদুস সাত্তার তেমন একটা এলাকায় আসেননি।
গত চার বছরে তিনি এলাকায় এক টাকার উন্নয়নকাজও করাতে পারেননি। আবার দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের সহায়তা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। এসব কারণে তার প্রতি মানুষের ক্ষোভ জন্মেছে। সরকার তাঁকে যেভাবেই হোক জেতাবে—এটা ভোটারদের কাছে স্পষ্ট ছিল। তাই ভোটারদের ভোট নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না।
ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে আবু আসিফের স্ত্রী মেহেরুননিছা মেহেরীন প্রথম আলোকে বলেন, এটা জনগণের নীরব প্রতিবাদ। এযাবৎকালে সংসদ সদস্য নির্বাচনে এত কম ভোট কখনো পড়েনি। এটা ইতিহাস সাক্ষী। তিনি আরও বলেন, কোনো কেন্দ্রে ৭টা, কোনো কেন্দ্রে ২০টা ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশন ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে পারলে আমেজ থাকত।