গার্মেন্টের পণ্য চুরি করে একটি চক্র। তাও সব পণ্য নয়, রফতানির জন্য প্রস্তুত করা উন্নতমানের পণ্য। রফতানির চালান হিসেবে গার্মেন্ট থেকে যখন পণ্যগুলো বের করা হয়, মাঝপথে কৌশলে চুরি করা হয় সেখান থেকে। প্রায় দেড় যুগ ধরে এভাবে শত কোটি টাকার পণ্য চুরি করেছে চক্রটি। চোরচক্রের মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা। চুরির টাকায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে তিনি নির্মাণ করেছেন বাড়ি ও মাছের খামার। শাহেদকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব জানায়, গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রফতানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান এক লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায়। সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করেন। তবে গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া একটি ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যায় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। সেখানে দেখা যায় যে, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি। অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরবর্তীতে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয়েছে মালিকপক্ষকে।
এই ঘটনার পর গার্মেন্টসের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করে। এই অভিযোগের পর রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব। চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারও করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে র্যাব-৪ এর পৃথক পৃথক অভিযানে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। ব্রাজিলে রফতানিকৃত গার্মেন্টস পণ্য চুরিসহ দেশের অন্যান্য গার্মেন্টে পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত চক্রের মূলহোতাও গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছে বলে র্যাব দাবি করে। গ্রেফতাররা হলেন- মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২), মো. ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০) ও মো. হৃদয় (২৮)। এ সময় উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রফতানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ড ভ্যান।
গতকাল শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গ্রেফতার শাহেদ গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতের মাস্টারমাইন্ড, এই চক্রের মূলহোতা ও নির্দেশদাতা। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে।
তিনি জানান, ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টেসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে।
রফতানিযোগ্য পণ্য চুরি হতো যেভাবে: খন্দদার আর মঈন বলেন, প্রত্যেকটি চুরির আগে ড্রাইভারদের মাধ্যমে বিদেশে রফতানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতো চোরেরা। ব্রাজিলে রফতানিকৃত পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ড ভ্যানে লোড করে সন্ধ্যার সময় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ড্রাইভার শাহজাহানের কাছে স্যাম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। শাহজাহান স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ স্যাম্পল পেয়ে এই চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায়। পণ্যের গুণগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়।
৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরানো হয়: গার্মেন্ট থেকে রফতানির জন্য পণ্য রওনা হওয়ার পর চক্রটি চুরির কাজ শুরু করে। যানবাহন থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে আবার প্যাকেজিংয়ের পর বন্দরের পাঠিয়ে দেয় তারা।
ব্রাজিলের চালানটি চুরির সময় ‘মাস্টারমাইন্ড’ শাহেদের নির্দেশে ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে কাওছার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে ড্রাইভার ও হেলপার ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়ায় আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ড ভ্যানটি পার্ক করে। সেখানে পণ্য চুরির ঘটনাটি ঘটায়। আগে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে অপেক্ষারত কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে শেলটারদাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জন লেবার নিয়ে মূলহোতা কাওছার প্রত্যেকটি কার্টন থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়।
এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুম ওরফে মাসুদকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গত ২৪ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে র্যাবি। অপর একটি গার্মেন্টের পণ্য চুরির ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয় তাদের। বর্তমানে আসামিরা জেল হাজতে রয়েছে।
শাহেদ যেভাবে মাস্টারমাইন্ড : কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতার শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ২টি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করে। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার এবং হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই স্বশরীরে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
শাহেদ ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ সে পেত। শাহেদ গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে এই গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে। মৌলভীবাজার শহরে শাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির ওপরে মাছের খামারসহ হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে দুটি। বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ চোর চক্রে মোট ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচারকার্য চলমান রয়েছে।