হিজাব আল্লাহ তায়ালার ফরজ বিধান। হিজাব নারীর প্রতীক এবং মর্যাদার পরিচায়ক। এটি তাদের অহঙ্কার ও অলঙ্কারতুল্য। বর্তমান বিশ্বে হিজাব পরিহিতা নারীরা সগৌরবে সারা বিশ্বে বিচরণ করছেন। তারা পাইলট, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, কূটনীতিক, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, স্পিকার, মহাকাশবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এ পদচারণাই প্রমাণ করেছে, হিজাব নারীর উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায় নয়; বরং এটি তাদের উন্নতি ও প্রগতির সোপান। তাদের আত্মসম্মান ও সম্ভ্রমের সুরক্ষাকবজ। বর্তমান বিশ্বে বহু হিজাবধারী নারী রয়েছেন, যারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বদরবারে অত্যন্ত গ্রহণীয় ও বরণীয়। যেসব নারী হিজাবকে উন্নতি ও প্রগতির স্মারক হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-
ফাতিমা আবু শানাব : ফাতিমা আবু শানাব একজন তুর্কিয়ে নারী। তিনি একজন ফরেন পলিটিক্স এক্সপার্ট ও ট্রান্সলেটর। তিনি বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সুপার হিরো তুর্কিয়ে প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগানের ফরেন পলিসি এক্সপার্ট ও বিশিষ্ট ট্রান্সলেটর। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষনেতা ও ক্ষমতাধর এরদোগানের সাথে সব বৈদেশিক মিশনে মর্যাদার সাথে হিজাব পরে সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ২৬ বছর বয়সী এই হিজাবি নারী। তিনি হিজাব পরিধানের মধ্য দিয়ে নীরব বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন গোটা বিশ্বে। অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, সামান্য এক হিজাব কিভাবে তাকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেল? বিস্ময় জাগলেও এটিই বাস্তবতা যে, অনন্য এ মর্যাদার পোশাক তাকে নিয়ে গেছে মর্যাদা ও সম্মানজনক এক আসনে। কিন্তু কই! ফাতিমা আবু শানাবের হিজাব তো তার উন্নতি কিংবা প্রগতি অথবা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় বা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি? বরং হিজাবের কারণে সারা পৃথিবীতে তিনি মর্যাদার আসন লাভ করে আছেন। আজ সারা বিশ্বে হিজাবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর মুসলিম প্রেসিডেন্টের সাথে বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন তিনি।
মার্বে কাবাকুসি : তিনি ফাতিমা আবু শানাবের গর্বিত মা। তিনি বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী নারীর মধ্যে একজন। মাত্র দুই দশক আগের কথা। তুরস্কের প্রথম হিজাবধারী মহিলা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলে ডেপুটি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমেরিকায় পড়াশোনা করেও তিনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে নিজেকে বিলিয়ে দেননি। হিজাব পরে পার্লামেন্টে শপথ নিতে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশ করেছিলেন। হিজাব পরার কারণে তাকে তৎকালীন তুরস্কের সেক্যুলার সরকার সংসদে শপথ পর্যন্ত পড়তে দেয়নি। সে দিন সেক্যুলার এমপিরা চিৎকার করে বলেছিল- ‘বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও’।
তৎকালীন সেক্যুলার প্রধানমন্ত্রীও চরম গোঁড়ামি প্রকাশ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এই মহিলাকে লাইনে আনুন’। ১৯৮০ সালে তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে জনসমাগমে হিজাবকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমপি পদ থেকে বহিষ্কার করে নাগরিকত্বও কেড়ে নেয়া হয়েছিল কাবাকুসির। তিনি শেষে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আজ এই কাবাকুসির মেয়ে ফাতিমা আবু শানাব তুর্কিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সব বৈদেশিক মিশনে মর্যাদার সাথে হিজাব পরে সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ইলহান ওমর : ইলহান ওমর সোমালিয়া বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী। সোমালিয়া থেকে কিশোর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন ইলহান ওমর। এরপর ১৭ বছর বয়সে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। ২০১৮ সালে মিনেসোটা থেকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবার নির্বাচিত দুই মুসলিম নারীর একজন, যিনি হিজাব পরে মার্কিন কংগ্রেসে হাজির হয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। শুধু তাই নয়, পবিত্র কুরআন মাজিদে হাত রেখে শপথ নিয়ে আরেক নজির সৃষ্টি করেছেন ইলহান ওমর নামের এই হিজাবি নারী। তিনি এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘হিজাব ছাড়ব না। হিজাবকে প্রতিরোধক হিসেবে নিয়েছি, যদিও তা সবসময় সহজ নয়।’ টুইটে তিনি আরো লিখেছেন, তিনি শুধু ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে হিজাব পরেন তা নয়; বরং হিজাব পরে তিনি আনন্দও পান।
সারাহ আল আমিরি : তার পূর্ণ নাম সারাহ বিনতে ইউসুফ আল আমিরি। তিনি ১৯৮৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরব আল আমিরাতের বিজ্ঞানী পরিষদের প্রধান এবং ‘হোপ’ বা আশা প্রকল্পের ডেপুটি ম্যানেজার। তাকে প্রথমে দেশটির বিজ্ঞানীদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়। তারপর বিশ্বের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মন্ত্রীও করা হয় তাকে। এ সুযোগে তিনি দেশটির মন্ত্রিসভায় উন্নত বিজ্ঞানমন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষাজীবনে তিনি দুবাই শহরে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তখনো তার আগ্রহ কমেনি। একপর্যায়ে তিনি এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধীনে মুহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টারে চাকরির সুযোগ পান। সারাহ আমিরি যে সময় এই স্পেস সেন্টারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন, সে সময় আরব আমিরাতের প্রথম স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম দুবাইস্যাট-১-এর কাজ চলছিল। প্রথম প্রোগ্রামেই চমৎকারভাবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন। দুবাইস্যাট-১ সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর কাজ করেন দুবাইস্যাট-২ প্রোগ্রামে। দ্বিতীয় মিশনটিও ছিল সফল। এরপর তিনি আমিরাতের আরো একটি স্যাটেলাইট মিশন খলিফাস্যাটেও কাজ করেন এবং সেখানেও প্রশংসিত হন।
২০০৯ সালে সারাহ আমিরি তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর মাত্র পাঁচ বছর পর আরব আমিরাত সরকার তাকে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করে। ২০১৪ সালে তাকে আরব আমিরাতের অ্যাডভান্সড এরিয়াল সিস্টেমস প্রোগ্রাম স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি তা শুরু করেন এবং সফলভাবে একটি ঐঅচঝ স্যাটেলাইট নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন। ঐঅচঝ প্রোগ্রামের এক বছর পর সারাহ আমিরি তার জীবনের আরো এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক স্পর্শ করেন।
২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বর্ষসেরা ৫০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন নির্বাচিত হন। কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তাকে একের পর এক সফলতা এনে দেয়। ২০১৬ সালে ২৯ বছর বয়সে তিনি এমিরেটস সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে তিনি বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরামে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেছিলেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে তিনি দেশটির উন্নত বিজ্ঞানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ২০ জুলাই, ২০২০ সালে তারই নেতৃত্বে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জাপানের থ্যানগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে জাপানের রকেটে করে আমিরাতের মহাকাশযান ‘হোপ’ যায় লাল গ্রহের দিকে। এটি আরব দুনিয়ার প্রথম মহাকাশ অভিযান। এর মধ্য দিয়ে সফলভাবে শুরু হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের মঙ্গল অভিযান। আরবের এই দেশটির মঙ্গলযাত্রা ওই অ লের নারীদের জন্যও একটি মঙ্গলবার্তা।
হালিমা বিনতে ইয়াকুব : সিঙ্গাপুরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হালিমা বিনতে ইয়াকুব। হোটেলকর্মী থেকে সিঙ্গাপুরের প্রথম মুসলিম প্রেসিডেন্ট। পেশায় পাহারাদার মোহাম্মাদ ইয়াকুবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট হালিমা জন্ম নেন ১৯৫৪ সালে। তার বয়স যখন আট বছর তখন পিতা মারা যান। মা সংসার চালাতে হোটেলে ঝিয়ের কাজ নেন। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে হালিমা মায়ের সাথে হোটেলে প্লেট গ্লাস ধোয়ার ও ফরমায়েশ শোনার কাজ করতে থাকেন। কিন্তু এ দারিদ্র্য তার লেখাপড়া থামাতে পারেনি। আইন পড়া শেষ করার মাধ্যমে ক্ষুধার সাথে যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন হালিমা। আইন পেশা থেকে ২০০১ সালে সিঙ্গাপুর পিপলস অ্যাকশন পার্টির কর্মী হিসেবে যোগদান করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন তিনি। পরপর চারটি নির্বাচনে জয়লাভ করে নিজের অবস্থান জানান দেন সবাইকে খুব ভালোভাবে। হালিমা ইয়াকুব ২০১১ সালে সামাজিক উন্নয়ন, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার মনোনীত হয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় চলে আসেন সিঙ্গাপুরের এই মুসলিম মহীয়সী নারী। তিনি ২০১৭ সালে স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং বিজয়ী হন। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনের মারাত্মক খারাপ সময়গুলোতে অনেকবার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি; কিন্তু যখন ভেবেছি যে, আমি একজন মুসলিম তখন আবার ফিরে এসেছি সে সিদ্ধান্ত থেকে। আবার নতুন করে জীবন সাজাতে শুরু করেছি।’ (অসমাপ্ত) লেখক : সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া