রাজা হওয়ার শখ খুব ছোটকাল থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছিল। নানী-দাদীদের মুখে রূপকথার রাজা-রানী-রাজপুত্রদের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ইত্যাদি শোনার পর অন্য সব শিশুর মতো আমিও রাজা হতে চাইতাম। বড় একটি রাজ্য- হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া এবং রাজ অন্তঃপুরে ভুবনমোহিনী রানীর আদরযতেœর কথা স্মরণ করে যারপরনাই শিহরিত হতাম। পোলাও-কোর্মা-কালিয়া-কোপ্তা-জর্দা-ফিরনির পাশাপাশি অঢেল আপেল-কমলা আঙ্গুর বেদানার লোভও আমাকে রাজা হতে প্রলুব্ধ করত। রাজার গলায় মুক্তার মালা, মস্তকে হীরকখচিত মুকুট, পরনে রাজকীয় রেশমি বস্ত্র, কোমরে তলোয়ার, পিঠে তীর নিয়ে রাজা সিংহাসনের সামনে পায়চারি করছেন আর লোকজন জাঁহাপনা জাঁহাপনা করছে- এমন দৃশ্য নাটক সিনেমায় দেখার পর রাজা হওয়ার বাসনা তীব্রতর হলো এবং মানবিক সত্তার সহজাত প্রবৃত্তির কারণে নানামুখী চিন্তা-চেতনা, মন-মস্তিস্কে ঘুরপাক খেতে থাকল।
গল্পকারদের বয়ান অনুসারে জানলাম যে, রাজা হওয়ার জন্য অনেক পন্থা রয়েছে। প্রথমত, রাজার ঘরে জন্ম নেয়া অথবা রাজকন্যা বিয়ে করা। সাধারণ পরিবার থেকে রাজা হওয়ার জন্য দুটো উপায় রয়েছে। প্রথমটি হলো কপালে রাজটিকা থাকা এবং দ্বিতীয়টি হলো তলোয়ারের মাধ্যমে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে সিংহাসন দখল করা। আমি যেহেতু শৈশব থেকেই দুর্বল শরীরের অধিকারী ছিলাম এবং আমাশয় এবং খুঁজলিতে আক্রান্ত ছিলাম তাই যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। শত্রুর আক্রমণের মুখে আমাশয়ের যন্ত্রণা এবং খুঁজলির কারণে বিশেষ অঙ্গে চুলকানি নিয়ে তলোয়ার চালানো যে সম্ভব নয় তা আমি সেই শিশু বয়সেই বিলক্ষণ টের পেয়েছিলাম। সুতরাং যুদ্ধ ছাড়া রাজা হওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিগুলো খুঁজতে থাকলাম এবং চিন্তার জগতে নি¤œরূপ ব্যুৎপত্তি ঘটাতে লাগলাম।
আমি প্রথমেই খুঁজতে থাকলাম, আমার কপালে কোনো রাজটিকা রয়েছে কিনা। এটা করতে গিয়ে আমি বহুমুখী সমস্যায় পড়লাম। প্রথমত, রাজটিকা কেমন এবং কপালের কোন স্থানে এটি থাকে তা আমার জানা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এটা কপালের চামড়ার উপরে থাকে নাকি নিচে থাকে তা নিয়েও আমার সন্দেহ ছিল। বিষয়টি নিয়ে আমি কারো সাথে আলোচনাও করতে পারছিলাম না। কারণ, শিশু হলেও আমার লজ্জাশরম ছিল খুব বেশি। দ্বিতীয়ত, প্রাণের ভয়ও ছিল মারাত্মক। কারণ গল্পের মাধ্যমে জেনেছিলাম যে, কারো কপালে যদি রাজটিকা থাকে আর সেই খবর যদি রাজার কানে যায় তবে টিকাধারী শিশুর কিল্লা ফতে হয়ে যায়। রাজার লোকজন এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং শিরচ্ছেদ অথবা জীবন্ত কবর দিয়ে দেয়।
উল্লিখিত কারণে আমার মনের সুপ্ত বাসনা নিয়ে নড়াচড়া করাটা যে বিপজ্জনক তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম। বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে জাসদের ওপর সরকারের তা-ব, বাকশালীদের দৌরাত্ম্য এবং রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের খবর অজপাড়াগাঁয়ে এতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে, মানুষ একাকী পাটক্ষেতে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতেও ভয় পেত। ফলে বেশির ভাগ মানুষ রাতবিরেতে সদল বলে পাটক্ষেতে ঢুকত এবং নিরাপদ দূরত্বে কাশাকাশি করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে দিতে কাজকর্ম সারত। সুতরাং সেই ভয়ের রাজ্যে নিজের কপালে রাজটিকা খোঁজা যে কতটা দুঃসাহসিক বিষয় ছিল তা এ যুগের শিশুরা কল্পনাও করতে পারবে না।
রাজটিকা ছাড়া রাজা হওয়ার দ্বিতীয় পদ্ধতি নিয়ে ভাবতাম। অর্থাৎ রাজপুত্র হওয়া অথবা রাজকন্যা বিয়ে করা। এ ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল ঝক্কিঝামেলা সব বাবা অথবা শ্বশুরের ওপর দিয়ে যাবে। আর আমি কেবল ঘোড়ায় চড়ে ফুটানি দেখাব, তীর ধনুক নিয়ে হরিণ শিকার করব এবং বিয়ের পর রাজকন্যাকে নিয়ে সুখ শান্তিতে বাস করব। কাজেই রাজপুত্র হওয়া এবং রাজকন্যার পতি হওয়ার জন্য দোয়া করা ছাড়া আমার এ ক্ষেত্রে করণীয় কিছু নেই বিধায় দোয়াদরুদের তালাশ শুরু করে দিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল এক বিপত্তি। এক রাতে রেডিওতে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত মধুবালা নাটকটি সপরিবারে শ্রবণ করলাম। নায়ক মদন কুমারের অভিশপ্ত জীবন, মদন কুমার মধুবালার বিরহ এবং রাজকন্যা-রাজপুত্রদের নিয়ে জিন-পরীদের খেলাধুলা আমার মনে আতঙ্ক ধরিয়েছিলো। আমার কাকার নিকট মদন কুমারের করুণ পরিণতির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, বেশির ভাগ রাজা এত বেশি জুলুম-অত্যাচার-পাপাচার করে যে, তাদের ছেলে-মেয়েরা অভিশপ্ত উন্মাদ-ক্ষ্যাপাটে-পঙ্গু অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়।
কাকার কথা শোনার পর আমার মাথা থেকে রাজপুত্র হওয়ার বাসনা কিংবা রাজকন্যা বিয়ে করার কামনা চলে গেল। আমার মনে হলো ভিক্ষা করে খাবো কিন্তু কোনো অত্যাচারী রাজার অভিশপ্ত পাগল রাজপুত্র হবো না। অন্যদিকে, ঘুঁটে কুড়ানি পল্লীবালা বিয়ে করব কিন্তু কোনো হারামখোর বদমাস রাজার অভিশপ্ত রাজকন্যার স্বামী হবো না। আমার শিশুকালের সেই চিন্তা কিশোর বয়সে এসে আরো পরিপক্ব হলো। বিশেষ করে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের অমর নাটক ইডিপাস পড়ার পর আমার মনে রীতিমতো ভয় ঢুকে গেল। আমি কল্পনার রাজ্যের অলীক কর্মকা- বাদ দিয়ে বাস্তব চিন্তা, পরিশ্রমলব্ধ সফলতা এবং জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোযোগ দিলাম। ফলে কিছু দিন পর অনুভব করলাম যে, কর্ম এমন একটি জিনিস যার ফলে সফলতা অথবা ব্যর্থতা মানুষের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। সুতরাং সফল হওয়ার জন্য কী ধরনের কর্ম আবশ্যক তা নিয়ে আমি নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করলাম।
রাজা হওয়ার বিষয়ে হঠাৎ করেই আমার শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ল মূলত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চমক দেখার পর। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে এবং লোকজন ইতোমধ্যেই নয়া রাষ্ট্রপতির আদিঅন্ত, দক্ষিণ-পশ্চিম অথবা উত্তর-পূর্ব জেনে গেছেন। কাজেই এসব নিয়ে আমার মতো অধমের অযোগ্য আলোচনা অবান্তর ও বিরক্তিকর হতে পারে বিধায় আজকের শিরোনাম নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করা যাক। শৈশবে রাজা হওয়ার আকাক্সক্ষা কিংবা ছাত্রজীবনে ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক হওয়ার কারণে কিনা জানি না, আমি কর্মজীবনে এখনো রাজা বাদশাহ হতে না পারলেও দেশ বিদেশের বহু রাজা-বাদশাহর সান্নিধ্য পেয়েছি। রাজনীতির রাজা, রাজপথের রাজা। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদনের রাজা ছাড়াও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সিংহাসনে আসীন রাজা বাদশাহ ও রাজপুত্রদের সান্নিধ্য পেয়েছি। বই পুস্তকে বহু সফল রাজার ইতিহাস পড়েছি এবং কুলাংগার রাজাদের নারকীয় তা-বের কাহিনী জেনেছি। রাজনীতির মতো একটি জটিল ও কুটিল বিষয়ে একজন রাজা কিভাবে সব সফলতার মূলমন্ত্র হতে পারেন তার উদাহরণ আমি দেখেছি হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা:, হজরত ওমর ইবনুল আব্দুল আজীজ, বাদশাহ হারুন আল রশিদ, সুলতান সুলেমান কিংবা বাংলার শাসক আলাউদ্দিন হুসেন শাহের জীবনীতে।
অন্য দিকে, একজন রাজা কিভাবে সব অকল্যাণের নিয়ামক হয়ে জমিতে খোদায়ী গজবের প্রতিভূরূপে পৃথিবীতে জাহান্নামের আগুনের ঝড় বইয়ে দিতে পারেন তার নিকৃষ্ট নমুনা দেখেছি রাশিয়ার জার আইভান দ্য টেরিবল, রোমান সম্রাট নিরো, ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই, হিটলার, মুসোলিনি, ইয়াহিয়া, টিক্কার কর্মকা-ের মাধ্যমে। নিকৃষ্ট রাজাদের নির্মম কর্মকা-ে রাজ্য নষ্ট হয়-প্রজা কষ্ট পায়- এমন প্রবাদ অতি পুরোনো এবং কমবেশি সব দেশেই এটি প্রচলিত। রাজা মন্দ হলে জনজীবনে কি নারকীয় তা-ব চলে তা বোধ করি বদ্ধ উন্মাদকেও বলে দিতে হবে না। সুতরাং ওসব বিষয়ে না বলে রাজার দোষত্রুটির লক্ষণ এবং কারণ নিয়ে ইতিহাসের চিরন্তন প্রবাদগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
ইতিহাসের নষ্ট তালিকায় সর্ব নিকৃষ্টদের যে দোষটি সবার আগে বর্ণিত হয়েছে সেটি হলো জন্মে ত্রুটি। পিতা-মাতার অবৈধ সন্তান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন রাজ্যে যেসব অনাসৃষ্টি ঘটে সেগুলোর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। জন্ম ছাড়াও শৈশবে বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গতার কারণেও রাজার কর্ম খারাপ হতে পারে।রাজার কুকর্মের দ্বিতীয় স্তরের নিয়ামক হলো তার অশিক্ষা এবং কুমন্ত্রণাদাতাদের প্রভাব। অশিক্ষিত রাজারা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য সারি সারি শিক্ষিত লোকজনকে আমির-ওমরাহ, পাইক-পেয়াদা, উজির-নাজির, কতোয়াল হিসেবে ভাড়া করে। কিন্তু কার্যত তারা এসব লোকজনকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করে এবং নিজেদের সমপর্যায়ের অশিক্ষিত লোকজন দ্বারা কিচেন ক্যাবিনেট বানিয়ে রাজ্য চালাতে থাকে। ফলে দুষ্ট রাজাদের ঘোড়ার আস্তাবল রক্ষক, রান্নাঘরের পাচক, ঘরের ঝাড়–দার কিংবা নরসুন্দর অনেক সময় সেনাপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় প্রজাদের কষ্ট, দুর্ভোগ-দুর্দশার সীমা পরিসীমা থাকে না।
দুষ্ট রাজাদের চরিত্রহীনতার দুর্গন্ধ একটি রাজ্যকে রীতিমতো নরক বানিয়ে ফেলে। আর্থিক দুর্নীতি, ভোগের লিপ্সা, কৃপণতা এবং বিকৃত যৌনাচার ইত্যাদি নানা উপসর্গ যখন রাজার চরিত্রে দেখা যায়, তখন পুরো রাজ্যে বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, অবিচার, অনাচার, জুলুম-অত্যাচার ইত্যাদি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। রাজার সাথে পাল্লা দিয়ে তার পাত্র-মিত্ররা বাইজিমহল গড়ে তোলে। সম্পদের পাহাড় তৈরির জন্য নরমু-, মানুষের অস্থিমজ্জা ও রক্ত-মাংস বিক্রির হাট বসায়। মানুষের মান-সম্মান, চাহিদা প্রয়োজন এবং প্রিয় বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ তখন রাজার নিত্যকার শখ আহলাদের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
মহাকালের ইতিহাসে যখন উল্লিখিত পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ঠিক তখনই কবি অরুণ সরকার লিখে ফেলেন-
‘কাকের মুখে রটলো খবর বনের রাজা বাঘ মরেছে।
জন্তুরা সব একে একে মরা বাঘটা এলো দেখে।
কেউ করলো আহা উহু। কেউ ভাবলো বাঁচা গেলো।
কদিন পর বললো সবাই, বাঘ মরেছে এখন তবে
বনের একটা রাজা তো চাই, কে তাহলে রাজা হবে!
শেয়াল শুনে চুপি চুপি, মাথায় দিয়ে গাধার টুপি
লাফিয়ে উঠে সিংহাসনে, ডাকলো হুয়া হুক্কা রবে,
বললো- সেই রাজা হবে!
ভালুক বললো, এই বেয়াদব। ওখান থেকে নাম এখুনি,
রাজা হবো এই কথাটি ফের যদি তোর মুখে শুনি
একটি চড়ে অক্কা পাবি। হুক্কা-হুয়া ভুলে যাবি!
বাঘ নেই তো আমি আছি, বাঘের পরেই আমার দাবি!
নেকড়ে বলে, ভালোই আছো, করবে তুমি ভালুক নাচও
সিংহাসনে বসে আবার ভাবছো বুঝি রাজাও হবে
আমি হলাম বাঘের পিসে, আমার দাবি কমটা কিসে
আমায় রাজা করতে হবে!
হায়েনা বললো, হাসাস না আর, পিসি কোথায় ঠিক নেই তার
এলেন উনি পিসে মশাই, আমরা কোথায় যাইরে তবে,
আমায় রাজা করতে হবে।
বাঁদর বললো, ওরে হায়না জুড়ে দিলি তুইও বায়না
জানিস তো কেউ তোকে চায় না, ভাগাড় দিয়ে লেংচে চলিস
রাজা হবো তুইও বলিস! আমি বানর অর্ধেক নর, বনবাসী,
বুদ্ধিজীবী, আমায় রাজা করতে হবে সব্বাইকে বলে দিবি!’
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য