ক্ষমতাসীন জোটের শরিক হলেও সেই জোট এবং সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করে আবারও আলোচনায় এসেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতা তিনি। পাঁচবারের সংসদ সদস্য। ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। জোট রাজনীতি, আগামী নির্বাচন, বর্তমান সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন। সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোর সৌজন্যে দৈনিক খবরপত্রের জন্য ছাপানো হলো।-বার্তা সম্পাদক
প্রশ্ন: অতীতে আপনারা নিজ দলের প্রতীক হাতুড়ি এবং আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করেছেন। আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নেবেন না বলে আপনার বক্তব্যেই এসেছে। আসলে আপনাদের সিদ্ধান্তটা কী?
রাশেদ খান মেনন: ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির জাতীয় কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আমরা নিজস্ব প্রতীকে ভোট করব। এখনো এ সিদ্ধান্তে অটল আছি। গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, নিজেদের প্রতীকে ভোট করাই ভালো। আর আমরা সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের শক্তি স য় করেছি। নিজের শক্তিতেই এগিয়ে যেতে চাই। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটাও একটা কারণ।
প্রশ্ন:: নৌকা প্রতীক কি জনগণের কাছে কিছুটা আবেদন হারিয়েছে? নাকি অন্য কোনো কারণে নৌকা নিতে চাইছেন না?
রাশেদ খান মেনন: নৌকা প্রতীক আবেদন হারিয়েছে কি না, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে নৌকায় ভোট করে অতীতে কিছু বাস্তব সমস্যার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেমন, আমরা সংসদে অনেক সময় যে কথাগুলো বলতে চাই, নৌকা প্রতীকে ভোট করার কারণে তা পারি না। এ ছাড়া ১৪ দলে জোটের যে চর্চা হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। ওপরের দিকে আমরা বৈঠক করি, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা পৌঁছায় না। অর্থাৎ নিচের দিকে জোটের অস্তিত্ব নেই। ফলে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও মাঠপর্যায়ে কোনো কাজে আসে না। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এর উদাহরণ। আমরা সংসদে মানুষের কথা অকপটে বলতে চাই। নিজের শক্তির ওপর দাঁড়াতে চাই।
প্রশ্ন: ঠাকুরগাঁওয়ে উপনির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এই হারের কারণ কী?
রাশেদ খান মেনন: আমাদের প্রার্থী মনোনয়ন ভুল ছিল। করোনার সময় দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও তৈরি হয়েছে। তবে জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ আমাদের আসন ছেড়ে দিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগকে চিঠি দিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হয়ে নিজেই তো বলেছেন যে আওয়ামী লীগের নেতাদের সহায়তায় তিনি জিতেছেন।
প্রশ্ন: ১৪-দলীয় জোটের যাত্রা প্রায় দুই দশক আগের। শুরুর সঙ্গে তুলনা করলে জোট এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
রাশেদ খান মেনন: এখন বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতি বলেন আর নির্বাচন—কোনো ক্ষেত্রেই জোটের বাইরে গিয়ে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। বিএনপি অনেকগুলো দল নিয়ে জোট করেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং পশ্চিমবঙ্গেও জোট রাজনীতি ও জোটভিত্তিক নির্বাচন হচ্ছে। আসলে এ অ লের রাজনীতিতে জোট একটা সাধারণ ‘বৈশিষ্ট্যে’ পরিণত হয়েছে। ফলে জোট ছেড়ে দেওয়া বা ভিন্ন কিছু ভাবা মুশকিল।
প্রশ্ন: আপনারা তো ১৪ দলকে আদর্শিক জোট হিসেবে বলে আসছেন। তাহলে এটা কি ভবিষ্যতে শুধু নির্বাচনী জোটে পরিণত হচ্ছে?
রাশেদ খান মেনন: অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা, যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লালন করে আসছি, সেটার জন্যই ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়েছে। এখন জোট যদি সব সময়, সব পর্যায়ে কার্যকর না থাকে, তাহলে তো কিছু করার নেই। এখন আওয়ামী লীগ যদি শুধু নির্বাচনী জোটের দিকে নিয়ে যায়, তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। তখন ভোট এলে আসন নিয়ে সমঝোতা হবে। বাকি সময় যার যার রাজনীতি করব।
প্রশ্ন:আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনি কি মনে করেন ভোটটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হবে?
রাশেদ খান মেনন: আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোটগতভাবেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। আমরা এটা ধরেই এগোচ্ছি। সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হলে প্রতিযোগিতামূলক হবে। বিএনপি যে ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাদের আমলে তো আরও খারাপ পরিস্থিতি ছিল। আমি মনে করি, সবাই গুরুত্ব দিয়ে ভোটের মাঠে নামলে নির্বাচন ভালোই হবে।
প্রশ্ন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
রাশেদ খান মেনন: এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। পাকিস্তান আমলে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় কিছু ছাত্রসংগঠন যা করত, এখন সেই চর্চাই চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ঘোলাটে হচ্ছে। ছাত্রসংগঠন স্বাধীন নয় বলেই এমনটা হচ্ছে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কম দায়ী নই। তারা পদ-পদবির জন্য ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে একা অনশন করে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। এটা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। অন্য শিক্ষকদের অবস্থান তাহলে কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, শিক্ষকদের তো কোনো বিবৃতি পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কিছু কথা বলেছেন। এটা তো শিক্ষকদের জোরালোভাবে বলার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা থাকার কথা। সেটা তো দেখা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন: বর্তমান সরকার নিয়ে বলুন। মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সর্বত্র দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ। আপনি সরকারের অবস্থান কোথায় রাখছেন?
রাশেদ খান মেনন: মন্ত্রিসভার সদস্যদের সক্ষমতা নিয়ে মূল্যায়ন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা) নীতির কথা বলে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। দুর্নীতি শুধু এখন ওপর মহলে শুধু নয়, তৃণমূলেও পৌঁছে গেছে। অর্থ পাচার দিন দিন প্রসার হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কোথাও জিরো টলারেন্সের নীতি কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না।