ঝড়ের কবলে আদানির সাম্রাজ্য, পতন কি আসন্ন? আদানি গ্রুপের শেয়ারে কারসাজি, কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি আর আর্থিক লেনদেনে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশের পর টালমাটাল আদানির সাম্রাজ্য ভারতের গৌতম আদানি, স্কুল থেকে ঝরে পড়া এক বিলিয়নিয়ার যিনি হয়ে উঠেছেন এশিয়ার শীর্ষ ধনী, সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের শেয়ারে কারসাজি ও কৃত্রিম দাম বৃদ্ধিসহ আর্থিক লেনদেনে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর এক প্রতিবেদন প্রকাশের পর টালমাটাল হয়ে উঠেছে গৌতম আদানির সাম্রাজ্য। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা আদানি। একজন ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি, এখন গড়ে তুলেছেন বিশাল এক সাম্রাজ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই রাজ্যের বাসিন্দা। যে কারণে তাদের সম্পর্ক নিয়ে বছরের পর বছর ধরে সমালোচনা করতে দেখা গেছে বিরোধীদের।
আদানির ব্যবসায়িক আগ্রহের জায়গায় রয়েছে বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিমানবন্দর, খনি, ভোজ্য তেল, নবায়নযোগ্য জ্বালানি আর সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সিমেন্টের মতো খাত।
হারালেন শীর্ষ তৃতীয় ধনীর তকমা: মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, তিনদিন আগেও বিশ্বের তৃতীয় ধনী গৌতম আদানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে ২২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার হারিয়ে শীর্ষ ধনীর তালিকায় সপ্তম স্থানে নেমে গেছেন তিনি। দন্ত চিকিৎসক প্রীতি আদানির সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন আদানি, সংসারে রয়েছে দুই ছেলে, করণ ও জিৎ। তারা দুজনই বর্তমানে বাবার ব্যবসা দেখভাল করেন। সম্পদের পাহাড় গড়া ৬০ বছর বয়সী আদানি এক মধ্যবিত্ত টেক্সটাইল পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। এমন একটি দেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যেখানে অনেকেই তাদের সম্পদের উত্তরাধিকারী হন জন্মসূত্রে। আর অন্যান্য বিলিয়নেয়ারদের তুলনায় আদানির পরিচিতিও তেমন বেশি ছিল না। আদানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তির মতে, তার ব্যবসায?িক শৈলীকে ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আদানির সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে তার তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির স্টকও বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আগ্রাসী সম্প্রসারণের ঘটনাও ঘটেছে। গত তিন বছরে তার কোম্পানির স্টক বেড়েছে ১ হাজার ৫০০ শতাংশেরও বেশি।
মোদির সাথে ঘনিষ্ঠতাই আদানির সাফল্যের রহস্য? মোদির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় লাভবান হচ্ছেন বলে দেশটিতে বিরোধীদের যে অভিযোগ রয়েছে তা অস্বীকার করেছেন আদানি। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘মোদির বন্ধু ছিলেন কি না’ প্রশ্ন করা হলে আদানি বলেছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তার বন্ধু আছে, কিন্তু তিনি রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। তিনি বলেছিলেন, তার সাফল্যের পেছনে কোনো রাজনৈতিক নেতা নেই। সাক্ষাৎকারের সময় আদানির করপোরেট বিমান মোদির ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এশিয়ার এই শীর্ষ ধনী বলেছিলেন, মোদি বিমানের পুরো ভাড়া পরিশোধ করেছেন।
গত কয়েক বছর আদানি গোষ্ঠী ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম সবুজ হাইড্রোজেন ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার জন্য গত বছর আদানির সাথে চুক্তি করেছে ফ্রান্সের টোটাল এনার্জিস। অতি সম্প্রতি আদানি তার ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় থাকার পন্থা বেছে নিয়ে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। চলতি মাসে ভারতের জনপ্রিয় একটি হিন্দি টেলিভিশনের ‘পিপলস কোর্ট’ নামে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এ সময় আদালতের আদলে বানানো ‘কোর্টরুমে’র ভেতরে বসেন এবং তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে তিনি নিজেকে ‘একজন লাজুক ব্যক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং ‘রাজনৈতিক আক্রমণে’র মুখোমুখি হওয়াকেই তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ বলে জানান।
অনুষ্ঠানে দেশটির বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর কথা উল্লেখ করে আদানি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এবং এর পরে রাহুল গান্ধী তাকে ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কারণে মানুষ আদানিকে জানতে পেরেছে। এর তিন সপ্তাহ পর গত শুক্রবার আদানি গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দাম নজিরবিহীনভাবে কমেছে। চলতি সপ্তাহে এই গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান লোকসান ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের (বুধবার, ২৫ জানুয়ারি) পর এটা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আদানি অফশোর ট্যাক্স হেভেন ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। তবে গৌতম আদানি ওই প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন বলে জানিয়েছেন।
চ্যালেঞ্জের মুখে আদানির খ্যাতি: আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের রূপকল্প হল ‘ভালোর সাথে প্রবৃদ্ধির’ ভারসাম্য। কারণ জাতীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে সম্পদ তৈরি, আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্থায?িত্বের মাধ্যমে জনজীবনে রূপান্তর ঘটানো তাদের লক্ষ্য। দন্ত চিকিৎসক প্রীতি আদানির সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন আদানি, সংসারে রয়েছে দুই ছেলে, করণ ও জিৎ। তারা দুজনই বর্তমানে বাবার ব্যবসা দেখভাল করেন।
তবে বিতর্কের জন্য আদানি যে একেবারে অপরিচিত, বিষয়টি তেমন নয়। কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের কেরালায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে সেখানকার জেলেদের টানা কয়েক মাসের প্রতিবাদ এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে আদানির কারমাইকেল কয়লা খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে পরিবেশবাদী কর্মীরা প্রতিবাদ করেছেন। কার্বন নিঃসরণ এবং গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের ক্ষতির আশঙ্কায় তারা এই প্রতিবাদ করেন।
চ্যালেঞ্জ উৎরাতে পারবেন আদানি? নজিরবিহীন শেয়ার মূল্যের পতন কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেটাই এখন আদানির মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ এই গোষ্ঠীর ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজেস চলতি সপ্তাহে ভারতের বৃহত্তম পাবলিক সেকেন্ডারি শেয়ারের সূচনা করেছে; যার লক্ষ্য আড়াই বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা। শুক্রবার আদানির শেয়ারের দাম অফার মূল্যের চেয়ে অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এর সাফল্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
ভারতের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পরামর্শক দীলিপ চেরিয়ান রয়টার্সকে বলেছেন, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন এবং এর ফলাফল আদানির সুনামের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনি সেই ক্ষতি সীমিত করার পদক্ষেপ নিতে পারেন। গ্রুপের আর্থিক ও সম্পদের শক্তিশালী বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত এবং শেয়ার বিক্রির সাফল্য নিশ্চিত করতে পারেন।
চেরিয়ান বলেন, ‘আদানির যে উল্কাগতিতে উত্থান ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি এক ধরনের বিপত্তিই।’
গত ডিসেম্বরে ইন্ডিয়া টুডে টিভিকে আদানি বলেছিলেন, যারা গ্রুপ ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা কার বরাতে করছেন সেটি জানাননি। তারা গ্রুপের অর্থনৈতিক বিষয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেননি। মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের ব্যাপক দর পতনের পরপরই আদানিকে নয়াদিল্লিতে ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠকে যেতে দেখা গেছে। তবে সেই বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি। এই বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলেও আদানি গ্রুপ কোনো সাড়া দেয়নি।
আর্থিক পরিষেবা কোম্পানি জেফরিস বলেছে, আদানি গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ অভিযোগ করেছে, আদানির মূল তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ‘উল্লেখযোগ্য ঋণ’ রয়েছে যা পুরো গোষ্ঠীকে ‘অনিশ্চিত আর্থিক অবস্থানে’ ফেলেছে। কিন্তু আদানি গ্রুপ বার বার বলছে, তাদের সব ঋণই পরিচালনযোগ্য এবং কোনো বিনিয়োগকারীই উদ্বেগ জানায়নি।-ঢাকা পোস্ট