শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৬ অপরাহ্ন

গল্প: মনের মাঝে

সৌভিক চক্রবর্তী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩

রান্নাঘরের জানলা দিয়ে পশ্চিমের আকাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুপুর শেষে বিকেল নামার তোড়জোড় চলছে, নীল ক্যানভাসে লালচে-গোলাপির বেখেয়ালি ছোপ। নভেম্বরের মাঝামাঝি শহরের আবহাওয়া অদ্ভুতরকম ভালো। উত্তরদিক থেকে নরম হাওয়া বইছে, তার তালে তালে দিগন্তরেখার কাছে সারি বেঁধে দাঁড়ানো গাছগুলো মেক্সিকান ওয়েভের মতো মাথা দোলাচ্ছে। একবার ওপরে, একবার নীচেÍ যেন ডুবতে বসা সূর্যকে বিদায় জানাচ্ছে।
‘কুহুহুৃ কুহুহুৃ’
কোকিলের ডাকে বেজে ওঠা কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সবজি কাটার বোর্ড আর ছুরি একপাশে সরিয়ে রাখল বিনতা। বাবান স্কুল থেকে ফিরেছে, দরজা খুলতে হবে।
‘আসছিৃ’ তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ও। ছবির মতো সাজানো দক্ষিণ কলকাতার পশ রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স ‘স্বর্গদ্বার’-এর দোতলা বাংলোগুলো এমনিতেই বেশ বড়সড়, তার ওপর বাড়ির পেছনদিকের রান্নাঘরটাই বেশি ব্যবহার করে বিনতা। তাই ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা খুলতে একটু সময় লেগে গেল।
‘মাম্মা, আমি এসে গেছিৃ’
চার মাস আগে
‘প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা করুন। বিনুর এই অবস্থা আর দেখতে পারছি না আমি। না ভালো করে খাচ্ছে, না ঘুমাচ্ছে। সারাদিন মনমরা হয়ে বাবানের স্কুল ইউনিফর্ম, ড্রয়িং খাতা, কমিকস আগলে বসে থাকেৃ ডাকলেও সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে আপন মনে কথা বলে, হাসে, কাঁদে, কখনও আবার শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন সব কিছু ভুলে গেছেৃ’
‘রিল্যাক্স, শোভনবাবু। আমি বুঝতে পারছি, আপনাদের জীবন এই মুহূর্তে একটা তোলপাড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনি তাও সামলে উঠেছেন, কিন্তু আপনাদের একমাত্র ছেলে অন্তরীপÍ বাবানের এত অল্পবয়সে চলে যাওয়াটা আপনার স্ত্রী এখনও মেনে নিতে পারছেন না। তাই উনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে হলে ওঁর এই ডিলিউশন একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম, বাস্তবের দুঃখ-যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা। এর বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই, আর সেই লড়াই লড়তে গেলে সবার আগে আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।’
‘কী করে শক্ত থাকব, ডক্টর? রোজ রোজ এক জিনিসÍ আমি যে আর পারছি না। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, জানেন! ভয় হয়, বাড়ি ফিরে বিনুকে কী অবস্থায় দেখব সেই ভেবে। ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে পাগল পাগল লাগে, বেডরুমটা যেন হাঁ করে গিলতে আসে। গত পাঁচটা মাস এক বিছানায় শোওয়া সত্ত্বেও একবারওৃ আমাদের কনজ্যুগাল লাইফ বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। বারোটা বছর একসঙ্গে কাটানোর পর আজ যেন আমরা হঠাৎ ছিটকে গেছি দুদিকে, দুজন অচেনা মানুষের মতোৃ’
‘মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, মিঃ বিশ্বাস। আত্মীয় পরিজন, পরিবারের সদস্যদের নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। প্রিয়জনকে অকালে হারানোর যন্ত্রণা সেকারণেই এতটা বিহ্বল করে তোলে আমাদের। প্রথম প্রথম দুঃখের তীব্রতা খুব বেশি থাকে। যতই আমরা ঘটনাটাকে ভুলতে চাই, ততই গভীরভাবে সেটা দাগ কেটে বসে। তারপর আস্তে আস্তে কষ্টের পরিমাণ কমে; আমাদের মন সেই খারাপ স্মৃতিকে একটু একটু করে বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এর অন্যথা হলেই মুশকিল, যেটা আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়েছে। দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে বাস্তবকে রিজেক্ট করছেন তিনি।’
‘ডক্টর, প্লিজ, কোনও উপায়ই কি নেই? বিনুকে সুস্থ করে না তুলতে পারলে আমি বাঁচব না। আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হয়। বাবান তো চলেই গেছে, এরপর যদি বিনতাও কোনও ভুল পদক্ষেপেৃ’
‘এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আমি তো বলেছি, মিসেস বিশ্বাসকে সুস্থ করে তোলার সবরকম চেষ্টাই আমরা করব। নিন, একটু জল খান।’
কাঁপা হাতে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে নিল শোভন, ছোট একটা চুমুক দিয়ে মুখ মুছল।
‘আপনি প্লিজ বলুন ডক্টর, এখন আমার কী করা উচিত?’
‘দেখুন একটা কথা বলি। এ ধরনের কেসে অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে কনভেনশনাল ট্রিটমেন্ট, মানে ওরাল মেডিসিন বা সাইকোথেরাপি, সম্পূর্ণ সাকসেস দেয় না। আমি বলছি না ব্যর্থ হয়, কিন্তুৃ এইসব চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ, তার ওপর রিল্যাপ্স-এর একটা সম্ভাবনা রয়েই যায়। সবমিলিয়েৃ’
‘তাহলে? এই অসুখের আনকনভেনশনাল কোনও ট্রিটমেন্ট-ও আছে নাকি?’
‘তা একটা রয়েছে, কিন্তুৃ চিকিৎসার পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম, আর খরচের পরিমাণটাও বেশির দিকেইৃ’
‘খরচের চিন্তা করবেন না, ডক্টর। আপনি প্লিজ ট্রিটমেন্টটার ব্যাপারে বলুন। বিনুর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি।’
‘বিদেশে এই অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট বেশ কয়েকবছর ধরেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। বছর তিনেক আগে ইন্ডিয়া-তে এর ফ্র্যাঞ্চাইজি নেয় টেকনোহেলথ গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন, ‘মন কা সাথ’। প্রথমে হেড অফিস খোলে মুম্বইয়ে, তারপর একে একে ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদের মতো সবকটা বড় শহরে ব্রাঞ্চ বসায়। মাস ছয়েক হল কলকাতাতেও এসেছে ওরা, ‘মনের মানুষ’ নামে। এখানে ওদের ব্রাঞ্চ অফিস ব্রেবোর্ন রোডে। আমি অ্যাড্রেস লিখে দিচ্ছি, আপনি একবার ওখানে গিয়ে কথা বলুন।’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, এই ট্রিটমেন্ট-এ রিস্ক ফ্যাক্টর কিছু নেই তো? মানে কোনওরকম সাইড এফেক্টৃ?’
‘দেখুন, আমি এর আগে কোনও পেশেন্টকে ‘মনের মানুষ’-এ রেফার করিনি, তাই এতে রিস্ক আছে না নেই, বা থাকলেও কতটা, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যতদূর শুনেছি, ট্রায়াল ফেজ-এ সেরকম কোনও খারাপ এফেক্ট ধরা পড়েনি। আরোগ্য সদন-এ আমার এক কলিগ রয়েছেন, ডক্টর সিনহা, তাঁর কয়েকজন পেশেন্ট এই চিকিৎসায় যথেষ্ট উপকার পেয়েছেন। এখন আপনি ভেবে দেখুনৃ’
বিদেশে এই অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট বেশ কয়েকবছর ধরেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। বছর তিনেক আগে ইন্ডিয়া-তে এর ফ্র্যাঞ্চাইজি নেয় টেকনোহেলথ গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন, ‘মন কা সাথ’। প্রথমে হেড অফিস খোলে মুম্বইয়ে, তারপর একে একে ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদের মতো সবকটা বড় শহরে ব্রাঞ্চ বসায়। মাস ছয়েক হল কলকাতাতেও এসেছে ওরা, ‘মনের মানুষ’ নামে। এখানে ওদের ব্রাঞ্চ অফিস ব্রেবোর্ন রোডে।
‘ভাবাভাবির কিছু নেই, ডক্টর। জলে পড়া মানুষ খড়কুটো দেখলেও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি কালই বিনতাকে ওখানে নিয়ে যাব। আপনি প্লিজ আমাকে অ্যাড্রেসটা দিন।’
***
দরজা খোলামাত্র তিরবেগে ভেতরে ঢুকল স্কুল ইউনিফর্ম পরা বছর ছয়ের ফর্সা, গোলগাল ছেলেটা। কোনওরকমে পিঠের স্কুলব্যাগ, হাতের ওয়াটার বটল সোফায় নামিয়েই জড়িয়ে ধরল বিনতাকে।
‘আরে ছাড় আমাকে!’ ছেলের ভালবাসার আতিশয্যে হেসে ফেলল বিনতা। ‘রান্না বাকি আছে। তোর ফেভারিট চিজ পাস্তা বানাচ্ছি। যা, শিগগির হাতমুখ ধুয়ে আয়।’
‘আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে। জানো, রনি, আমন, শামিম সবার মা স্কুল ছুটির পর ওদের নিতে আসে, কী সুন্দর গল্প করতে করতে ওরা বাড়ি ফেরে! আর আমাকে স্কুলবাসে করে ফিরতে হয়। একদম ভালো লাগে নাৃ’
‘ধুর পাগল!’ ছেলের চুলগুলো ঘেঁটে দিল ও। ‘মাম্মাকে অফিস যেতে হয় না? আজ বাবানসোনার জন্মদিন, স্পেশাল পাস্তা বানাব, তাই হাফছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। কোথায় তুই খুশি হবি, তা না, বলছিস মাম্মা তোকে কম ভালবাসে!’ নকল অভিমানে বিনতা মুখ ভার করল।
‘এই না না! মাম্মা আমাকে ভালবাসে তো। আমি তো এমনি এমনি বলছিলাম।’ আরেকবার মাকে জড়িয়ে ধরল বাবান।
‘আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে।
‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি আমার মনের মাঝারে’
আপনি কি আপনার প্রিয়জনকে হারিয়েছেন?
আপনি কি চান আপনার হৃদয়জুড়ে থাকা সেই বিশেষ মানুষটাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনতে?
তাহলে আজই যোগাযোগ করুন আমাদের সঙ্গে, এবং ফিরে পান আপনার প্রিয়জনকে।
বিশদে জানতে ফোন করুন টোল ফ্রি এই নম্বরে ৯১১৯১১২২৪৯, অথবা যোগাযোগ করুন আপনার নিকটবর্তী ‘মনের মানুষ’ শাখা দপ্তরে।
আপনার মনের হদিস, জানে ‘মনের মানুষ’।
হাতে ধরা রঙিন ব্রোশিওর-টা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল শোভন। ‘মনের মানুষ’ ব্রাঞ্চ অফিসের দোতলায়, সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ ধীমান আহুজা-র চেম্বারে বসেছিল ও। ঘরটা বেশ বড়সড়, গোটাটাই কাচের তৈরি। দেওয়ালে দেড় টনের দুটো স্প্লিট এসি বসানো। ১৯ ডিগ্রির শুকনো হাওয়ায় বেশ ঠান্ডাই লাগছিল ওর। পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার মুখটা মুছে নিল শোভন, তারপর অন্যমনস্কতা ঝেড়ে টেবিলের ওপারে বসা মধ্যবয়সি মানুষটার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক তখনও বলেই চলেছেন
‘ৃ আপনি একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিঃ বিশ্বাস। প্রিয়জনকে হারানোর শোক মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। সিভিয়ার ডিপ্রেশন থেকে ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডারÍ কিছুই অসম্ভব নয়। আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রেৃ’
ঘরটা বেশ বড়সড়, গোটাটাই কাচের তৈরি। দেওয়ালে দেড় টনের দুটো স্প্লিট এসি বসানো। ১৯ ডিগ্রির শুকনো হাওয়ায় বেশ ঠান্ডাই লাগছিল ওর। পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার মুখটা মুছে নিল শোভন, তারপর অন্যমনস্কতা ঝেড়ে টেবিলের ওপারে বসা মধ্যবয়সি মানুষটার দিকে তাকাল।
কথার মাঝখানে থামলেন আহুজা। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর মুখস্থ বলে চলা কথাগুলো নতুন কাস্টমারের মনে সেরকম আগ্রহ জাগাতে পারছে না। একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আলতো হেসে আবার শুরু করলেন।
‘আমি জানি আপনি উৎকণ্ঠায় আছেন, মিঃ বিশ্বাস। এও বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে আপনার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। সেগুলোর উত্তর আমি অবশ্যই দেব, কিন্তু তার আগে এই ট্রিটমেন্ট বিষয়ে কিছু কথা আপনার জানা দরকার। সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড। ভয় নেই, বোর করব না!’ আরেকবার হাসলেন আহুজা। ‘দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বিজ্ঞানী নই, নেহাত সেলস ম্যানেজার। একজন লেম্যান হিসেবে এই ট্রিটমেন্ট সম্বন্ধে যা বুঝেছি, আপনাকে সেটুকুই বলব। একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লিজ, তারপর আপনার যা যা কোয়্যারি আছে আমাকে বলবেন।’
‘স্মৃতি কাকে বলে? উত্তরটা বেশ সহজ। ব্রেনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোনে সঞ্চিত তথ্যই হল স্মৃতি। কীভাবে এই তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়? বাইরে থেকে আসা উদ্দীপনার মাধ্যমে। বহিরাগত স্টিমুলাই ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস রূপে এক নিউরোনের অ্যাক্সন থেকে আরেক নিউরোনের ডেন্ড্রনে যায়। এক নিউরোনের অ্যাক্সন এবং অন্য নিউরোনের ডেন্ড্রনের মধ্যেকার যে ফাঁক, তাকে আমরা সাইন্যাপ্স বলি। স্মৃতি এই সাইন্যাপ্স দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। স্টিমুলাই গিয়ে মস্তিষ্কের নিউরোনের সাইন্যাপ্স-গুলোতে বদল আনে। সেই বদলটাই পরবর্তীতে স্মৃতির রূপ নেয়। যেমনভাবে ব্ল্যাঙ্ক ডিভিডি গান বা সিনেমা রেকর্ড করতে পারে, তেমনই ব্রেনের এক বা একগুচ্ছ নিউরোন ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস-কে মেমোরি হিসেবে রেকর্ড করে রাখতে পারে।
‘স্থায়ীত্বের দিক দিয়ে স্মৃতি দু’ ধরনেরÍ শর্ট টার্ম অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী এবং লং টার্ম বা দীর্ঘস্থায়ী। আবার মস্তিষ্কের কোন অংশে জমা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করেও স্মৃতির শ্রেণিবিভাগ করা হয়। হিপ্পোক্যাম্পাস, নিওকর্টেক্স, অ্যামিগডালা প্রভৃতি হল মানুষের ব্রেনের নানান প্রকোষ্ঠ, এগুলোতে সঞ্চিত স্মৃতির প্রকৃতিও একে অন্যের থেকে আলাদা। কোনওটায় শারীরবৃত্তীয় মোটর স্কিল বিষয়ক স্মৃতি জমা থাকে, কোনওটায় আবার স্কুল জীবনে শেখা পাঁচের ঘরের নামতা অথবা অমুক দেশের রাজধানীর নাম। কিন্তু সে সব নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও হবে। ‘মনের মানুষ’ কাজ করে অ্যামিগডালা নিয়ে, কারণ ইমোশনাল সমস্ত স্মৃতি ওখানেই জমা হয়।
‘মনোবিজ্ঞান বলে, আনন্দ, ভয়, সুখ, দুঃখ, আরাম বা ব্যথা জাতীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়। এরকম উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়। ধরুন আপনি একজন কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড মিটিংয়ের আগে হঠাৎ আপনার মনে পড়ে গেল যে বছর তিনেক আগের একটা মিটিংয়ে আপনার প্রেজেন্টেশন খুব খারাপ হয়েছিল। অথবা আপনি একজন ক্রিকেটার, ফাইনাল ম্যাচের দিন সকালে আপনার মনে পড়ল দশ বছর আগের গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ, যেখানে আপনি জিরো রানে আউট হয়েছিলেন’
‘কিন্তু এসবের সঙ্গে বিনতার অসুস্থতার সম্পর্ক কী?’ চেষ্টা করেও গলা থেকে ধৈর্য হারানোর ঝাঁঝ সরিয়ে রাখতে পারল না শোভন।
দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়।
‘আমি সেখানেই আসছিলাম,’ শান্তভাবে উত্তর দিলেন আহুজা। ‘আমাদের প্রিয়জনেদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্নেহের, ভালবাসার, আবেগের, হাসি-কান্নার। তাঁদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত প্রচ-ভাবে ইমোশনালি চার্জড হয়ে থাকে। ফলে এই স্মৃতিগুলো আমাদের অ্যামিগডালার একেবারে ওপরের তলেÍ সারফেস লেভেল-এ, সহজলভ্য অবস্থায় রয়ে যায়ৃ’
‘আর যদি কোনও প্রিয়জন, কোনও কাছের মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলি?’
‘তাহলে সেই স্মৃতিগুলো বাঁধভাঙা নদীর মতো আমাদের মনে এসে আছড়ে পড়ে। একবার নয়, বারবার। প্রতিক্ষণে মনে হতে থাকে, যে চলে গেছে তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো কত ভালো ছিল, কত সুখের ছিল! সেনসরি ওভারলোড-এ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি আমরা। হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এই ফেজ-টা সাময়িক, একটা সময় কমে আসে সেই স্মৃতিদের তীব্রতা, একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই আমরা। কিন্তু কয়েকজন সেটা কখনওই পারে না। মানসিক রোগের শিকার হয় তারা, যেমন আপনার ওয়াইফ হয়েছেন।’
‘স্মৃতি কাকে বলে?
‘বিনুৃআমার স্ত্রীৃ সুস্থ হয়ে যাবে তো, মিস্টার আহুজা? আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছি’
‘রিল্যাক্স মিঃ বিশ্বাস, চিন্তা করবেন না, আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব আমাদের। যাক, থিওরি অংশ শেষ। এবার শুধু ‘মনের মানুষ’ ট্রিটমেন্ট বিষয়ে কয়েকটা কথা বলব। আপনার মনে আছে হয়তো, আজ থেকে বছর কুড়ি আগে সাইকোসোমাড্রড থেরাপি নিয়ে কী হৈচৈটাই না হয়েছিল এ দেশে? মানসিকভাবে অসুস্থ অপরাধীদের সুস্থ করে তোলার জন্য একধরনের সাইকোসোম্যাটিক ট্রিটমেন্ট, যেখানে অপরাধীরা ধাপে ধাপে বিভিন্ন ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি সিন্যারিও-র মধ্য দিয়ে যেত? শুরু থেকেই এই থেরাপির ওপর সরকারের শিলমোহর ছিল, প্রথম প্রথম তো এর সাফল্যের হার দুর্দান্ত বলে প্রচারও করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। জানা গেল, নির্দিষ্ট এক শ্রেণির অপরাধী এই ট্রিটমেন্টে একেবারেই রেসপন্ড করে না। থেরাপিতে সাড়া না দেওয়া অপরাধীদের জোর করে কোমায় পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও সবার সামনে এসে পড়ল। নড়েচড়ে বসল মানবাধিকার কমিশন। সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হল। নিষিদ্ধ ঘোষণা হল সাইকোসোমাড্রড থেরাপি।
‘কিন্তু টেকনোলজি-টা রয়ে গেল। সাত বছর আগে ডক্টর ভার্গব-এর মেয়ের কাছ থেকে সাইকোসোমাড্রড-এর পেটেন্ট কিনে নিল টেকনোহেলথ গ্রুপ। একেবারেই আলাদা উদ্দেশ্যে। ক্রিমিন্যালি ইনসেন পেশেন্টদের সুস্থ করা নয়, প্রিয়জনেদের হারানোর যন্ত্রণায় জর্জরিত, মানসিক রোগের শিকার মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনা। প্রথমে ইউএস, ইউরোপে বিখ্যাত হল এই থেরাপি। তারপর এল আমাদের দেশে। জন্ম নিল ‘মন কা সাথ’। সেখান থেকেই আজকের ‘মনের মানুষ’।’
‘কিন্তু ব্যানড একটা টেকনোলজি কতটাৃ’
‘আপনি ভুল করছেন মিঃ বিশ্বাস। সাইকোসোমাড্রড থেরাপি আমাদের দেশে ব্যানড, তার টেকনোলজি-টা নয়। তাছাড়া আমাদের সায়েন্টিস্টদের হাতে সেটা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, ‘মনের মানুষ’ পুরোপুরি নিরাপদ ও রিস্ক ফ্রি একটা ট্রিটমেন্ট।’
‘এটা কীভাবে কাজ করে?’
‘সেটা বলে ফেললে তো ট্রেড সিক্রেট ফাঁস করতে হয়, শোভনবাবু। আর সত্যি বলতে আমি অত কিছু বুঝিও না। তবে এতদিনের অভিজ্ঞতায় যেটুকু জেনেছি সেটা আপনাকে বলতে পারি। প্রথমে আমাদের টেকনিশিয়ানরা পেশেন্টের মাথার ভেতর একটা ন্যানো কম্পিউটার ইমপ্ল্যান্ট করে। একেবারে মাইনর অপারেশন, পুরোপুরি যন্ত্রণাবিহীন। সেই কম্পিউটার পেশেন্টের ব্রেন থেকে ইনফর্মেশন সংগ্রহ করে ক্লাউড স্টোরেজে রাখে। অপারেশন-এর সাতদিন পর পেশেন্টকে একটা চশমা পরানো হয়, যা তার নিজস্ব ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইন্টারফেস তৈরিতে সাহায্য করে। এরপর শুরু হয় ট্রিটমেন্ট। ক্লাউড-এ জমা তথ্য ব্যবহার করে আমাদের সিস্টেম একটা সিমুলেশন তৈরি করে, কল্পবাস্তবের এক দুনিয়া যেখানে পেশেন্ট তার হারানো প্রিয়জনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ইন্টার?্যাক্ট করতে পারবে। চশমা অন করলেই পেশেন্ট সেই সিমুলেশন-এ ঢুকে পড়ে, বা আরও ভালো করে বললে সেই সিমুলেশন-এর অংশ হয়ে ওঠেৃ’
‘কিন্তু ক্রমাগত সিমুলেশনে আটকে থাকা পেশেন্ট যদি বাস্তব থেকে দূরে সরে যায়?’
‘এখানেই এই থেরাপি-র বিশেষত্ব। পেশেন্ট সিমুলেশন-এর জগতে থাকবে অবশ্যই, কিন্তু বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। আবারও একটা উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি অফিসের মিটিংয়ে রয়েছেন। বসের বোরিং প্রেজেন্টেশন দেখতে দেখতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে, তাই সবার চোখ বাঁচিয়ে কানে ব্লুটুথ হেডফোন লাগিয়ে গান শোনার কথা ভাবছেন। কিন্তু বস কড়া লোক, যখন তখন আপনাকে কোনও ফ্যাক্ট বা ফিগার সংক্রান্ত প্রশ্ন করে বসতে পারেন। বসের কথাগুলো তাই ইচ্ছে না হলেও আপনাকে শুনতে হবে। তখন আপনি কী করবেন? ইয়ারফোনের ভলিউম লো রাখবেন, যাতে পছন্দের গানের পাশাপাশি বস-এর বক্তব্যও আপনার কানে ঢোকে। অর্থাৎ আপনি মিটিংয়েও থাকবেন, আবার গানের জগতেও। আমাদের ট্রিটমেন্ট-কে এরকমই কিছু একটা ভেবে নিন। পেশেন্ট ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে তার মনের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে, একইসঙ্গে আপনার সঙ্গেও স্বাভাবিকভাবে ইন্টার?্যাক্ট করবে। আপনার পাশে বসে টিভি দেখতে দেখতেই হারানো প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করবে। আশা করি ব্যাপারটা বোঝাতে পারলামৃ’
অপারেশন-এর সাতদিন পর পেশেন্টকে একটা চশমা পরানো হয়, যা তার নিজস্ব ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইন্টারফেস তৈরিতে সাহায্য করে। এরপর শুরু হয় ট্রিটমেন্ট। ক্লাউড-এ জমা তথ্য ব্যবহার করে আমাদের সিস্টেম একটা সিমুলেশন তৈরি করে, কল্পবাস্তবের এক দুনিয়া যেখানে পেশেন্ট তার হারানো প্রিয়জনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ইন্টার?্যাক্ট করতে পারবে।
উঠে দাঁড়ালেন আহুজা। ‘অনেক কথা বললাম, মিঃ বিশ্বাস। এবার কাইন্ডলি একটু আসুন, আপনাকে আমাদের থেরাপির কিছু ডেমো ভিডিও দেখাই। যদি আপনার মনে আর কোনও প্রশ্ন থাকেও বা, আমার বিশ্বাস ডেমো দেখেই তার উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন।’
***
‘‘আচ্ছা মাম্মা, পাপা কখন আসবে?’
‘পাপার ফিরতে রাত হবে, সোনা। অফিসে যা কাজের চাপৃ’
‘কতদিন হয়ে গেল আমরা একসঙ্গে বসে ডিনার করি না।’ অভিমানে ঠোঁট ফোলালো বাবান। ‘প্লিজ মাম্মা, আজ বলো না পাপাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে। রাতে কেক কাটা হয়ে গেলে পিজ্জা অর্ডার করব। তারপর খাওয়া হয়ে গেলে সবাই মিলে স্কুবি ডু দেখব।’
‘পাপা কি পারবে? আচ্ছা দেখছি ফোন করে। তুই গিয়ে ইউনিফর্ম ছাড়। আমার পাস্তা বোধহয় এতক্ষণে পুড়েই গেল।’
‘মাই মাম্মা ইজ দ্য বেস্ট!’ একদৌড়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল বাবান। ওয়াটার বটল আর স্কুলের ব্যাগ সোফার ওপরেই পড়ে রইল।
আড়াই মাস আগে
‘হোয়াট ইজ দিস, বিনু? তোমাকে দু’সপ্তাহ আগে থেকে বলে রেখেছি আমার অফিস ট্যুরের ব্যাপারে। কথা ছিল একসঙ্গে ভাইজাগ যাব আমরা, কাজের ফাঁকে ছোট একটা ভ্যাকেশনও হয়ে যাবে। প্লেনের টিকিট হয়ে গেছে, হোটেলে বুকিং কনফার্ম, আর আজ বেরোনোর আগে তুমি বলছ তুমি যাবে না!’
‘স্যরি, আমার খেয়াল ছিল না গো। নাহলে আগেই না করে দিতামৃ’
সদ্য কামানো গালে আফটারশেভ লোশন লাগাচ্ছিল শোভন, স্ত্রীর কথা শুনে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল।
‘খেয়াল ছিল না মানে? আর না-ই বা করতে কেন? একটা কারণ তো থাকবে।’
‘বাবানকে একা রেখে কীভাবে যাব তোমার সঙ্গে? কে দেখবে ওকে? বাচ্চা একটা ছেলেৃ আর ওদের স্কুল ক্রেশের ওপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই সেটা আগেও বলেছি তোমাকে।’
‘বাবানকে একা! তুমি কি পাগল হয়েছ, বিনু? কোথায় পাচ্ছ তুমি বাবানকে?’
‘কোথায় বাবান মানে? স্কুলে গেছে ও, একটু আগেই বাসে তুলে দিয়ে এসেছিৃ’
‘স্টপ ইট, বিনু, স্টপ ইট রাইট নাও। আর একটা কথাও বলবে নাৃ’
‘কেন? কথা বলব না কেন? বাবান তোমারও সন্তান, শোভনÍ ওর ভালোমন্দ দেখা তোমারও কর্তব্য। শুধু অফিস নিয়ে থাকলেই চলে না। আমিও অফিস করি, কিন্তু আমার কাজ কখনওই আমার ছেলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
‘হোয়াট ননসেন্স! কীসের অফিস? তুমি চাকরি করতে, কোনও একসময়। গত ছ’মাসে একদিনও অফিসে যাওনি তুমি।’
‘এসব তুমি’
‘প্লিজ আমাকে শেষ করতে দাও। বাবানৃ বাবান মারা গেছে বিনু। ও আর আমাদের মধ্যে নেই। এই সত্যিটাকে কেন মানতে পারছ না তুমি?’
‘কী বলছ কী? লজ্জা করে না তোমার? বাবা হয়ে নিজের ছেলের সম্বন্ধে এমন জঘন্য কথাৃ ছি ছি! আমি তো ভাবতেও পারছি না।’
‘আমি জঘন্য কথা বলছি! নিজের দিকে তাকাও বিনু, দেখো একবার কী অবস্থা হয়েছে তোমার। একটা মিথ্যেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচছ দিনের পর দিন!’
‘শোভন, তোমার কী হয়েছে আমি জানি না, এরকম বিহেভ কেন করছ সেটাও জানি না। কিন্তু তোমার এইসব আজেবাজে কথা আমি শুনব না।’
‘বিনুৃ কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছিৃ’
‘না, একদম না! বাবানকে নিয়ে কিচ্ছু শুনব না আমিৃ কিচ্ছু নাৃ’
***
‘পাস্তা কেমন হয়েছিল, সোনা?’
‘খুব ভালো, মাম্মা। আমি আরেকটু খাব’
‘আচ্ছা বেশ, রাতে খাস।’
‘আর হোমওয়ার্ক করতে ভালো লাগছে না। বাকিটা কাল করি?’
‘একদম না, আর মাত্র তিনটে সাম। একেবারে করে উঠবে। হোমওয়ার্ক জমিয়ে রাখা মোটেই ভালো অভ্যেস নয়।’
‘কিন্তু মাম্মাৃ’
‘একবার বলেছি তো! সামগুলো কমপ্লিট করে তারপরেই উঠবে তুমি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, করছি সাম। বকছ কেন?’ অভিমানে গাল ফোলাল বাবান।
ছেলের কথা শুনে হাসবে না রাগ করবে ভেবে পেল না বিনতা। কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই আরেকবার কোকিলের কৃত্রিম অথচ সুরেলা ডাক বাড়িময় ছড়িয়ে গেল। কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে।
এখন আবার কে এল? বসার ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে ভাবল বিনতা।
***
দেড় মাস আগে
‘মিঃ আহুজা, আপনি নিজের মুখে আমাকে বলেছিলেন এই ট্রিটমেন্ট সম্পূর্ণ রিস্ক-ফ্রি, এর কোনও সাইড এফেক্ট নেই। প্লিজ, আমাকে বলতে দিন। দিনের পর দিন আমাদের ঘরে ঝামেলা চলছে, আমার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা আরও ডিটারিয়োরেট করছে, স্রেফ আপনাদের জন্য। কী বলছেন আপনি, স্টাটিস্টিক্যাল অ্যানোম্যালি! আমার স্ত্রী কোনও পরিসংখ্যান নয় মিঃ আহুজা, রক্তমাংসের একজন মানুষ। অনেক আশা নিয়ে আপনাদের কাছে গেছিলাম, ভেবেছিলাম একটা পথ পাব। কিন্তুৃ’
নিজের কানেই নিজের গলাটা কেমন ভাঙা, অসহায় শোনাল শোভনের। কোনওমতে নিজেকে সামলালো ও।
‘আপনাদের ট্রিটমেন্ট এত ওয়ার্থলেস সেটা যদি আগেৃ কেন? এর দায় আপনারা নেবেন না কেন? একজন অসুস্থ মানুষকে আরও অসুস্থ করে তুলেছে আপনাদের থেরাপি। শুনুন মিস্টার আহুজা, আমি কিন্তু এর শেষ দেখে ছাড়ব। কনজিউমার্স কোর্টে যাব, দরকারে থানা-পুলিশ করব। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইয়ু ক্যান গো টু হেলÍ’
‘কী হল শোভন, এরকম অসভ্যের মতো চিৎকার করছ কেন? বাবান পাশের ঘরে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসেছে’
বিনতা কথা শেষ করার আগেই ঘুরে দাঁড়াল শোভন, হাতের সেলফোনটা ছুড়ে মারল দেওয়াল লক্ষ করে। শব্দ করে ফেটে গেল স্ক্রিন, পেছনের কভার খুলে ব্যাটারি, সিম, এসডি কার্ড ছিটকে গেল এদিক ওদিক। শিউড়ে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেল বিনতা। শোভনের চোখেমুখে তখন আদিম হিংস্রতা!
‘শাট আপ! বাবান, বাবান, বাবানৃ ড্যাম ইয়ু, বিনু! আমার জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছ তুমি। অনেক হয়েছে, এভাবে আর চলতে পারে নাৃ’
‘তোমার জীবন! আমি শেষ করে দিচ্ছি? তুমি এরকম বলতে পারলে?’
‘হ্যাঁ, পারলাম, কারণ এটাই বাস্তব। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই বাস্তব। গত সাড়ে সাত মাস ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছ তুমি। সাইকায়াট্রিক ট্রিটমেন্ট করিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ভেবেছিলামৃ মনেপ্রাণে আশা করেছিলাম এই সিমুলেশন থেরাপি তোমাকে সুস্থ করে তুলবেৃ কিন্তু এখন দেখছিৃ’
‘না, এ হতে পারে না। মিথ্যে, মিথ্যে বলছ তুমি। আমার বাবানৃ এই তো একটু আগেও তোৃ’
‘ফর গড’স সেক, বিনু! তোমাকে বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত। একবারের জন্য অন্ততৃ বাস্তবের সামনে দাঁড়াও। প্লিজ।’
‘তুমি পাগল হয়ে গেছ, শোভন। ইয়ু আর আউট অফ ইয়োর মাইন্ড।’
‘আমি পাগল হয়েছি? আমি? হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেয়ে অফিস যাচ্ছি, বাজার করছি, বাড়ির সব কাজ করছি, তোমার এই ফালতু ট্রিটমেন্টের নামে মাসে লাখ টাকার বিল পেমেন্ট করছি। আর তুমি কী করছ? চোখে চশমা লাগিয়ে কল্পনার দুনিয়ায় টাইমপাস করছৃ’
‘তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারো না, শোভন।’
‘বেশ করব বলব। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। এত করলাম তোমার জন্য, তাও সুস্থ হওয়ার, ভালো হওয়ার ইচ্ছেটুকু জাগছে না তোমার মধ্যে? কেমন মানুষ তুমি? একবারের জন্যও বুঝছ না, কতটা যন্ত্রণা পাচ্ছি আমি? এত স্বার্থপর হয় কেউ?’
আচমকাই বিনতার দিকে ছুটে গেল শোভন, হ্যাঁচকা টানে স্ত্রীর চোখ থেকে ফাইবার গ্লাসের ফ্রেমলেস চশমাটা খুলে ফেলল। মুচড়ে দু টুকরো করে ছুড়ে দিল ডাস্টবিনে।
‘এটা আমার অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল।’
‘না, আমিৃ আমার বাবান। না’
***
‘সারপ্রাইজ!’
শোভনকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল বিনতার মুখে, পরক্ষণেই আনন্দের উজ্জ্বলতায় মিলিয়ে গেল সেটা।
‘তুমি যে বললে আসতে দেরি হবে? বাবান কত করে বলেছিলৃ আমি ওকে বললাম তোমার অফিসে কাজ পড়ে গেছেৃ’
‘ওটাই তো সারপ্রাইজ। আমার একমাত্র ছেলের জন্মদিন, আর আমি রাত দশটা অবধি অফিস করব? পাগল নাকি! সরো এখন, ভেতরে ঢুকতে দাও!’
‘হ্যাঁ, আসো। কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী?’
‘বাবানের জন্য গিফট। ছেলের জন্মদিনে বাবা খালি হাতে আসবে নাকি? রোবোকপের পুরো সেটটা কিনে ফেললাম, ওই যে যেটার জন্য আগের মাসে বায়না করেছিল।’
‘খুব ভালো করেছ। বাবান খুব খুশি হবে।’
‘জানি তো। চটপট ডাকো ওকে। কেক-ও এনেছি, চকলেট, বাবানের ফেভারিট।’
সোফার ওপর শরীরটা এলিয়ে দিল শোভন। বাক্স খুলে কেক বের করে টেবিলে রাখল। যতœ করে বসাল ইংরেজি ‘সিক্স’ সংখ্যার আদলে গড়া, সাদা-সবুজ-গোলাপি রঙের ম্যাজিক ক্যান্ডেল।
জন্মদিনে আনন্দ করে কেক কাটবে বাবান। গিফট পেয়ে কী খুশিটাই না হবে!
সব পরিকল্পনা করে রেখেছে শোভন। কেক কাটার পর জমিয়ে ডিনার, তারপর একসঙ্গে বসে হরর মুভি দেখা। ইভিল ডেড। বাবান অবশ্য বেশিক্ষণ টানতে পারবে না, সিনেমা শুরু হওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঢুলতে শুরু করবে। তারপর একসময় বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুম। শোভন তখন নিশ্চিন্তে বিনতার গালে আঙুল বুলিয়ে দিতে পারবে, কপাল থেকে সরিয়ে দিতে পারবে অবাধ্য চুল। হাতে হাত রেখে সিনেমা শেষ করবে ওরা, সেই আগের মতোৃ
আচমকা শোভনের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে উঠল। নিমেষে যেন পালটে গেল সবকিছু। কোথায় কেক, কোথায় গিফটের প্যাকেট? টেবিলের ওপর এক ইঞ্চি পুরু ধুলোর আস্তরণ। চারদিক নোংরা, এলোমেলো। সোফার একপাশে ডাঁই করে রাখা এঁটো খাবারের প্লেট, বিরিয়ানির মোড়ক, পিজ্জার বাক্স। সারা মেঝে জুড়ে আধপোড়া সিগারেট ছড়ানো। গড়াগড়ি যাচ্ছে মদের বোতল, বিয়ারের খালি ক্যান।
চোখ থেকে ফাইবার গ্লাসের চশমাটা খুলে হতভম্বের মতো এদিক ওদিক তাকাল শোভন। একটু আগে দেখা ঘরটাকে, মানুষগুলোকে খুঁজতে চাইল যেন। অসুস্থ লাগছিল ওর। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, যেন অনেকদিন ঘুমোয়নি। নিজেকে দেখলে হয়তো চিনতেও পারত না ও। পরনে ছেঁড়া জামা, ময়লা প্যান্ট। গালে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি, চুল উসকোখুসকো। বয়সটা যেন এক ধাক্কায় দশ বছর বেড়ে গেছে!
টুং করে একটা শব্দ। ফোনে মেসেজ ঢুকল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল শোভন, চোখ কচলে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ‘মনের মানুষ’ থেকে এসএমএস এসেছে। ওর প্রিমিয়াম প্ল্যানের ভ্যালিডিটি-র মেয়াদ শেষ। প্ল্যান রি-অ্যাক্টিভেট করার জন্য এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকার রিচার্জ করাতে হবে।
শোভনের মাথার ভেতর চিন্তাভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যেতে লাগল। ‘মনের মানুষ’ থেকে তো বিনুর জন্য থেরাপির ব্যবস্থা করেছিল শোভন, যাতে ও বাবানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। থেরাপিতে কাজ দেয়নি। সবসময়ই বাবানকে দেখতে পাওয়া শুরু করল বিনুৃযে বাবান তো নেই, সেই কবেই অ্যাক্সিডেন্টেৃ কিন্তু বিনু? বিনুই বা কোথায়? এতক্ষণ হয়ে গেল, আসছে না কেন?
না, বিনুও তো আর নেই। দেড় মাস আগে, যেদিন তুমুল ঝগড়া হয়েছিল ওদের মধ্যে, সেদিনই দুপুরবেলায় অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করেছিল বিনু। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ওর প্রাণহীন, নিথর লাশটা দেখতে পেয়েছিল শোভন। এই সোফাতেই।
শোভনের চোখের সামনে যেন একটা কালো পর্দা মেলে দিয়েছিল কেউ। তাতে অস্পষ্ট কিছু ছবি ভেসে উঠছিল থেকে থেকে। দমবন্ধ হয়ে আসছিল ওর। স্মৃতির দরজা একবার খুলছিল ফের বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের পর স্ত্রীকেও হারিয়ে উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিল শোভন। বিনুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ি করে আত্মহত্যাও করতে গেছিল, কিন্তু হাতের শিরা কাটার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেনি। শেষকৃত্য সেরে তিনটে দিন মদের ঘোরে আচ্ছন্নের মতো কাটানোর পর ওর মনে পড়েছিল ‘মনের মানুষ’-এর কথা। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, আহুজার সঙ্গে দেখা করতে। তারপর হাতড়ে হাতড়ে মানিব্যাগ-টা খোঁজার চেষ্টা করল শোভন। ডেবিট কার্ডের নম্বরটা মনে নেই, দেখে টাইপ করতে হবে। রিচার্জটা এখুনি করে ফেলতে হবে, বেশি রাত হলে আবার ‘মনের মানুষ’-এর সার্ভার স্লো হয়ে যায়, সার্ভিসেও নানারকম সমস্যা হয়।
বিনু আর বাবানকে ছাড়া একটা রাত তো দূর, এক মুহূর্ত কাটানোর কথাও ভাবতে পারে না ও।
কিন্তু এত দেরি হচ্ছে কেন? অনেকক্ষণ হল ডাকতে গেছে বিনু, এখনও বাবান এল না কেন? কেক কাটতে হবে তো। তারপর ডিনার, সিনেমা একসঙ্গে কত মজা, হৈচৈৃ
উদভ্রান্তের মতো ‘মনের মানুষ’ হেল্পলাইনের নম্বর টিপতে লাগল শোভন। রিচার্জ-টা ওকে এখুনি করাতে হবে, যেভাবেই হোক।
লেখক পরিচিতি: সৌভিক চক্রবর্তী: সৌভিক চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৯০ সালে, কলকাতায়। ‘গভর্মেন্ট কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সেরামিক টেকনোলজি থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক, বর্তমানে ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’-য় কর্মরত। বিদেশি সাহিত্য, বিশেষ করে পাশ্চাত্য হরর, থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসির প্রতি আকর্ষণ ছেলেবেলা থেকেই। ‘আনন্দমেলা’, ‘কিশোর ভারতী’, ‘শুকতারা’, ‘চির সবুজ লেখা’, ‘নবকল্লোল’, ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র মতো নামী পত্রিকায় মৌলিক এবং অনুবাদ কাহিনি লিখেছেন সৌভিক, নিবন্ধ লিখেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’-র পাতায়। বিগত কয়েক বছরে ‘বি বুকস’, ‘অরণ্যমন’ ও ‘জয়ঢাক’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদিত একাধিক ইংরেজি ও বাংলা গল্পসংকলন। সৌভিক ভালোবাসেন গান শুনতে এবং সিনেমা দেখতে। নেশা গিটার বাজানো।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com