সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগেও বিশ্বাসযোগ্য খবরের মাধ্যম হিসেবে এখনো শীর্ষে রয়েছে খবরের কাগজ। সম্প্রতি ভারতীয় মিডিয়া পরামর্শক সংস্থা ওরম্যাক্স মিডিয়ার এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে, ৬২ শতাংশ স্কোর পেয়ে জরিপে প্রথম স্থান পেয়েছে ছাপার কাগজ। আর ৫৭ শতাংশ ও ৫৬ শতাংশ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রেডিও ও টেলিভিশন সংবাদ। ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, জরিপটি এমন এক সময় প্রকাশ করা হলো যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা খবরের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং ভুয়া খবরও ভয়ানকভাবে বাড়ছে।
‘খবরের বিশ্বাসযোগ্যতার সূচকে’ জরিপটিতে ওরম্যাক্স মিডিয়া ভারতের ১৭টি রাজ্য এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রায় দুই ৪০০ গ্রাহকের মতামত নিয়েছে। যাদের প্রত্যেকের বয়স ১৫ বছরের ওপরে এবং শহরে বসবাস করেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬১ শতাংশ খবর প্রাহক ভুয়া খবর গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। ওরম্যাক্স মিডিয়া প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শাইলেশ কাপুর বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও ভুয়া খবর একটি আলোচ্য বিষয় এবং দিনদিন এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।
ভারতের সবচেয়ে বড় মিডিয়া গ্রুপ বেনেট কোলেম্যান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড (বিসিসিএল); যা টাইমস গ্রুপ নামে পরিচিত। বিসিসিএলের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান শিভ কুমার সুন্দরম বলেছেন, এতে আমার কোন সন্দেহ নাই যে, ছাপার কাগজ আরো অনেক বছরই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম হিসেবে টিকে থাকবে। ছাপা কাগজের (কোন খবর) আরো বেশি খাঁটি ও যাচাইকৃত। যে কারণে মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমে যে খবর পড়ছেন তা নিশ্চিত হতে আবার সংবাদপত্রের জন্য অপেক্ষা করেন। ‘ভারতে সংবাদপত্র কেবল সংবাদ সরবরাহকারী মাধ্যম নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ যোগ করেন তিনি। জরিপকারী সংস্থার প্রধান শাইলেশ কাপুর যোগ করেন, আমরা এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর এই জরিপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। যাতে সময়ের সাথে সাথে ভুয়া খবর নিয়ে ভোক্তাদের উপলব্ধি জানতে লিপিবদ্ধ করা হবে। ভারতের এই মিডিয়া বিশ্লেষক বলেন, আদর্শগতভাবে টেলিভিশনের খবর সংবাদপত্রের খবরের মতোই হওয়া উচিৎ। কিন্তু তা হচ্ছে না। নিকট ভবিষ্যতে টেলিভিশনের জন্য এটি ‘বড় একটি সমস্যা’ হয়ে দাঁড়াবে।
খবরের জন্য সামাজিক যোযোগ মাধ্যমগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার পরিমাপ করা হয় জরিপে। এ সূচকে সবার ওপরে রয়েছে টুইটার। যা টেলিভিশনের খবরের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রায় কাছাকাছি। তবে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম বলেই জরিপের সূচক নির্দেশ করছে। এরমধ্যে টেলিগ্রাম ৩১ শতাংশ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে, ফেসবুক ৩০ শতাংশ নিয়ে তৃতীয়, ইনস্টাগ্রাম ২৯ শতাংশ স্কোর নিয়ে চতুর্থ এবং ২৮ শতাংশ স্কোর নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে।
ভুয়া খবরই কি বেশি ভালো লাগে আমাদের?: জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচ ভেলে ‘ ভুয়া খবরই কি বেশি ভালো লাগে আমাদের’ একটি প্রতিবেদন এবছরের এপ্রিলে প্রকাশ করেছিল। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলা: ইউটিউব, ফেসবুকে মাঝেমাঝেই ঝড় তোলে কিছু শিরোনাম। হাজার-হাজার ক্লিক, লাখ-লাখ ভিউ পায় সেগুলো। খবরগুলো করোনাকেন্দ্রিক, তবে গুজবভিত্তিক।
পেশার খাতিরে আজকাল ইউটিউবে একটু বেশিই সময় দিতে হয়। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কোন ধরনের ভিডিও বেশি চলছে, কেনো বেশি চলছে সেগুলো ঘাঁটার, বোঝার চেষ্টা করি। বর্তমানে সেরকমই এক টপিক হচ্ছে করোনা। এই টপিকে যাতে ভুয়া খবর বেশি না ছড়ায় সেজন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউব। মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি করোনা সংক্রান্ত ভিডিও প্রমোশনের জন্য নেয় না। অর্থাৎ কেউ চাইলেও বৈধ পথে ইউটিউবে করোনা সংক্রান্ত ভিডিও পয়সা দিয়ে প্রমোট করতে পারবে না। ভুয়া খবরের প্রসার রোধে ইউটিউবের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এমনটাও দেখা যাচ্ছে যে করোনা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে এমন ভিডিও ইউটিউবে তেমন একটা সাড়া পাচ্ছে না কারণ প্রতিষ্ঠানটি সেটিকে স্বয়ংক্রিয় প্রথম পাতায় কিংবা ‘রেকমেন্ডেশনে’ যায়গা দিচ্ছে না। কিন্তু ইউটিউবের এসব উদ্যোগ গুজব বা ভূয়া খবর রোধে কতটা সহায়ক হচ্ছে?
কয়েকটি ভিডিওর শিরোনাম পড়ুন: ‘করোনা কার তৈরি? বলে দিলেন ব্রিটিশ বক্সার! জাতিসংঘে চীনকে নিয়ে এ কেমন দাবি আইসিজির!’’ ‘‘চীন কি ইচ্ছাকৃত ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস্ত।। চীনের এতো বড় ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে কত বড় কারণ?’’ ‘‘এই ১৫ তথ্যই প্রমাণিত করে চীন সারা বিশ্বকে ধ্বংস করে দেবে খুব শীঘ্রই।। চীনের ষড়যন্ত্রে জ্বলছে বিশ্ব’’ ‘‘কোরোনায় ইহুদিদের এ কি হাল!! প্রবাসীদের সু-খবর দিলো সৌদি !! দেশবাসীর প্রতি খালেদা জিয়ার পরামর্শ’’ ‘‘চীনের মুসলমানের জন্য আশির্বাদ করোনা ভাইরাস! আজ তারা প্রকাশ্য নামাজ পড়ছে’’
এসব শিরোনামের ভিডিওগুলোর কোনটিরই ভিউ চার লাখের কম নয়, মন্তব্য হাজার হাজার। অথচ ভিডিওগুলো শুধু গুজব কিংবা ভুয়া বা অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিতে। এসব ভিডিও-র মানও বলার মতো নয়। অথচ মানুষ সেসব দেখছে, এবং ছড়িয়েও দিচ্ছে। এমনকি ইউটিউবের নানা উদ্যোগও ভিডিওগুলোর প্রচার থামাতে পারছে না। শুধু ইউটিউব কেন, ফেসবুকেও দেখছি করোনা ভাইরাস নিয়ে নানা রকম গুজব মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে। অমুক দেশের তমুক করোনা নিয়ে দিয়েছেন বিস্ফোরক তথ্য – এমন রিপোর্ট বা ভিডিও আমার ইনবক্সেও জড়ো হচ্ছে। অথচ সেই তমুক ব্যক্তিটি হয়ত এমন কেউ যার করোনা নিয়ে কথা বলার কোন যোগ্যতা বা অবস্থান – কোনটিই নেই। আর তিনি এমন কিছু বলেছেন যেটা বাস্তবসম্মত বা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে না হলেও সাধারণ মানুষ শুনতে চান। সাধারণ মানুষের এই শোনার আগ্রহের সঙ্গে গুজব বা ভুয়া খবর ছড়ানোর একটি সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি। আপনি যতই সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ দেন না কেন, সমাজের একটি অংশ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে করোনা হচ্ছে এক জীবাণু অস্ত্র যা চীনের তৈরি কিংবা বিধর্মীদের মারতে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছে এই ভাইরাস। ফলে, কেউ যখন তাদের সেই বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কিছু প্রকাশ করছেন, সেটা হয়ে যাচ্ছে ভাইরাল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গড়ে ওঠা এই বিশাল সংখ্যার ভুয়া খবর, গুজবে বিশ্বাসী পাঠক, দর্শকদের কিভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা যায় সেটা মাঝেমাঝে ভাবি। কিন্তু, সুনির্দিষ্ট কোন সমাধান পাইনা। হয়ত সঠিক তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া একটি সমাধান হতে পারে। আপনার কাছে কি আর কোন সমাধান আছে?