সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান শুরু হতে না হতেই শিল্পাঞ্চল মাধবদীর নিত্যপণ্যের বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। রোজার শুরু থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত আকাশছোঁয়া এ দাম কোথায় গিয়ে থামে তা নিয়েই এখন দরিদ্র ও নি¤œবিত্তের মানুষের যত চিন্তা। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে কি কোন পণ্যের দাম বেড়েছে? গত শুক্রবার সকালে এ প্রশ্নের জবাবে মাধবদী বাজারের মুদি ব্যবসায়ী জসিম মোল্লা বলেন, সবকিছুরই তো দাম বেড়ে রয়েছে, আর কত বাড়বে? কোন পণ্যের দাম কমেছে কি না এ প্রশ্নে তার সাফ জবাব, এ দেশে কোনকিছুর দাম বাড়লে আর সেটা কমে না। জানা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসন ও ট্যাংয়ের দাম। আর আগে থেকে বাড়তি চিনি, তেল, আটা-ময়দার দাম কমেনি। এছাড়া সবজি ও মাছ সহ বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এ ব্যাপারে অনেক ক্রেতারাই মনের ক্ষোভের কথাও বলতে চান না। তবে মাঝে মধ্যে দুই/একজন কিছু কথা বললে বুঝা যায় তাদের মনের মধ্যে কি যেন একটা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে, এমনভাবে কথা বলেন তারা। তাদের কথা হচ্ছে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, সেভাবে আয় বাড়েনি ফলে কোথায় থেকে এই বাড়তি টাকা আসবে। কিভাবে সংসার চালাবে। আর এভাবে বাড়তে থাকলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে। ক্রেতাদের মধ্যে একটা কষ্টের নিশ্বাস ফেলতে দেখা যায়। রোজার শুরু থেকেই মাধবদী বাজারে অস্বস্তিতে রয়েছেন ক্রেতারা। উদ্বেগ বাড়ছে নি¤œআয়ের মানুষের। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে নাভিশ্বাস উঠছে নি¤œ ও নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের। এ-দোকান ও-দোকান ঘুরেও সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না অনেকে। প্রতিদিনের ডাল-ভাতের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রমজানের শুরুতেই অনেকেই রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনেতে গিয়ে বাড়ি ফিরছেন খালি হাতে। সাধ থাকলেও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে তাদের। অনেকে বাজারে গিয়ে দরদাম করেই ফিরে আসছেন। কেউ কেউ দাম একটু কমার অপেক্ষা করছেন। তবে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও যে রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন থাকবে সেটা বুঝতে বাকি নেই সীমিত আয়ের মানুষের। আর সে কারণেই তাদের যত অস্বস্তি। রোজায় ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসনের বেশি ব্যবহার হয়। গত কয়েকদিনে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এমনকি শরবত তৈরির জন্য যে ট্যাং লাগে বাজারে সেটাও এখন রিতীমতো সংকট। যদি পাওয়া যায় তার মুল্য রীতিমতো আকাশ ছোঁয়া। যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে তারাও বিক্রি করছেন গত রমজানের থেকে কেজিপ্রতি প্রায় ২শ টাকা বাড়তি দামে। বর্তমান বাজারে ট্যাং ১৪শ থেকে ১৫শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এদিকে বাজারে গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। মাসখানেক আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা দরে, যা এখন ৯০-৯৫ টাকা। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দামও বেড়েছে ৫-১০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। এছাড়া অ্যাংকর ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ৭০-৮০ টাকা এবং একইভাবে বেসনের দাম বেড়ে ১শ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরেই বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে তেল-চিনি মিলছে না। বেঁধে দেয়া দামে প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১১৭ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০থেকে ১৫০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ১৮২ থেকে ১৯০ টাকায়। খোলা চিনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত দাম ১০৭ টাকা হলেও এখনও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি বাজারেই নাই। যদিও পাওয়া যায় তবে লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৬০/ ১৮০ টাকায়। এদিকে মসলার বাজারে আদা-রসুনের বাড়তি দাম কমেনি। উল্টো পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুরগির বাজার এক-দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি এখন ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ১০/১৫ টাকা কেজিতে বেড়েছে। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা দরে। মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম কেজিতে প্রায় ১শ টাকা বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৮শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস ১১শ টাকা, লাল লেয়ার ৩৫০ টাকা, সাদা লেয়ার ৩৪০, ব্রয়লার ২৫০/২৫৫, কক মুরগি ৩৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাধবদী বাজারের খাসির মাংসের দোকানি জামান মিয়া বলেন, বাজারে মাংসের দাম বেশি। ক্রেতা একবারে নেই বললেই চলে। আগে ৫/৬ টা খাসি জবাই করতাম। প্রচুর ক্রেতা থাকত। এখন সাহস করে একটি ছোট খাসি জবাই করি। মাঝে মধ্যে সেটিও পরোপুরি বিক্রি করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, দাম তো আর আমরা বাড়াই না। আমাদের খাসি কিনতেই হয় বেশি দামে। তাই আমাদের করার কিছু থাকে না। গরুর মাংসের দোকানি ফারুক মিয়া বলেন, এখন সাধারণ মানুষের কাছে টাকা কম। বাজারদর বেশি। আজ দুটি গরু মিলে ৫ মণ মাংস হয়েছে। বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিয়ে দোকানে অল্প রেখেছি। একটা সময় প্রতিদিনই ৮-১০ মণ মাংসের ব্যবসা ছিল। সেটা কমে গেছে। বাজারে আজ ক্রেতা অনেক কম। মুরগি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বেশ কিছু দিন ধরেই মুরগির দাম বাড়তি। গরু-খাসির দাম বাড়তি থাকায় সাধারণ মানুষ এই মুরগিই বেশি কিনত। আগে যে পরিমাণ বেচতাম, গত ২ সপ্তাহে বেচা-বিক্রি তার অর্ধেকে নেমেছে। আজকের বাজারেও আমাদের মুরগি কিনতে হয়েছে ২২০ টাকায়। বিক্রি করছি ২৪০/২৫০ টাকায়। এই ১৫/২০ টাকার মধ্যেই আমার দোকানের যাবতীয় খরচ, আমাদের লাভটা থাকে কই? দোকানে এনে মুরগিকে তো খাবার দিতে হয়, মুরগীর খাবারের দাম তো আরও আগে থেকেই বেড়ে আছে। মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২শ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪শ টাকা, শিং ৪শ টাকা, কই ৩শ টাকা, টেংড়া ৬শ টাকা, পাঙাস ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কাতল মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩শ থেকে ৩৫০ টাকায়, শোল মাছ ৬শ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাধবদী বাজারে বাজার করতে আসা একজন টেক্সটাইল মালিক ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া বলেন, বর্তমানে বাজারে মাংস কেনা তো মুশকিল আবার মাছের বাজারও চড়া। তবে আগে তেলাপিয়া, পাঙাস, চাষের কই এমন জাতীয় মাছগুলো কিনে খাওয়া যেত কিন্তু এখন তাও প্রচুর দাম। বিক্রেতারা এসবের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আয়-ব্যয়ের হিসাব এখন মেলানো যাচ্ছে না। ডাল, ভাত, মাছ সবজি খেয়ে যারা কোনভাবে টিকে থাকছে তাদেরও এখন বিপদ। অতিরিক্ত দামের কারণে আমরা সাধারণ মানুষ আগে থেকেই ভালো মাছ খেতে পারি না। আর যেসব কমদামি মাছ ছিল এখন সেগুলোর দামও বেড়ে গেছে। একইভাবে বেড়েছে সবজির দাম।
আমরা সাধারণ ক্রেতারা কোথায় যাবো? মাধবদী বাজারের কাঁচা মাল সবজি তরকারী ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন আনু জানান, শীতের শেষের দিকে থেকেই সব ধরনের তরকারীর মুল্য বাড়তে শুরু করছে। এদিকে সবজির বাজারে ইফতার শুরুর আগেই বেড়ে গেছে লেবুর দাম। এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকা পর্যন্ত। আর বোম্বে লেবু হালি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২শ থেকে ২৫০ টাকায়। একই কারণে বাড়ছে বেগুনের দামও। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন ৬০-৭০ টাকা, যা সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে শীতের শেষের দিক থেকেই বাড়তি দামে সব ধরনের সবজি বিক্রি শুরু হয়েছে। দুই একটি সবজি ছাড়া কোন সবজিই ৪০/৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। পটোল প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, টমেটো প্রতি কেজি ৪০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, করল্লা ৮০ টাকা, ওস্তে ১২০ টাকা, সজনে ২০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, শিম ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রমজান ঘিরে যেভাবে বেড়েছে দ্রব্যমুল্য তাতে শিল্পাঞ্চল মাধবদীর নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সিমীত আয়ের মানুষ এখন দিশেহারা।