আমাদের শৈশব ছিল মোটামুটি প্রযুক্তিবিহীন। মোবাইল ফোন কী জিনিস, তা তখন বুঝতে পারা ছিল অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। কম্পিউটারের কথা তো মাথাতেই আসতো না। আমাদের মন পড়ে থাকতো স্কুলের আঙিনায়, খেলার মাঠে; নদী-বিলে লাফ-ঝাঁপ করে, গাছে চড়ে নানান দুষ্টুমিতে শৈশবের দিনগুলো পার হতো। নদীতে সাঁতার দেওয়া, বিশেষ করে বর্ষাকালে সাঁতরিয়ে স্কুল হতে বাড়ি ফেরার কী যে এক আনন্দময় মুহূর্ত ছিল, তা উপলব্ধি করতে পারি এখন। তার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারি, আমাদের মতো বর্তমান সময়ের শিশুরা সময়টাকে মোটেও উপভোগ করতে পারছে না। তার এক কারণ মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার। আমাদের সময় প্রযুক্তির প্রভাব বর্তমানের মতো জোরালো না থাকায় সেদিকে আমাদের আগ্রহ ও মনোযোগ কোনোটাই হয়তো ছিল না; কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিপণ্যের ছড়াছড়িতে শিশুরাও যেন মোবাইল-কম্পিউটার চালনায় বড়দের থেকে দক্ষ। আমরা যে সময়টা বাইরে ব্যয় করে বড় হয়েছি, সে সময়টা এখনকার শিশুরা মোবাইল-কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে বড় হচ্ছে। নানান কারণেই সেই আগের মতো মানুষে মানুষে মেলামেশার প্রবণতা যেমন কমছে, তেমনই প্রযুক্তিপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের ঘরমুখী করছে, যার প্রভাব পড়ছে বর্তমান সময়ের শিশুদের ওপর। এই সময়ের শিশুদের ভাবনার জগত ক্রমশ কমে আসছে। স্কুল থেকে বাসা, বাসায় বসে মোবাইল-কম্পিউটারে সময় দেওয়া। আবার পরের দিন স্কুলে যাওয়া। এইতো তাদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের পৃথিবীটাকে সঠিকভাবে অবলোকন করতে পারছে কতজন শিশু? অভিভাবকদের সামগ্রিক ব্যস্ততার প্রভাবও পড়ছে শিশুদের ওপর। তাই শিশুরা বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য অভিভাবকের থেকে যথেষ্ট সময় যেমন পাচ্ছে না, তেমনই তারা নিজেদের মানসিক গঠনে অভিভাবকদের সহযোগিতা কম পাচ্ছে, প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে পাচ্ছে অবাধ স্বাধীনতা। এ প্রেক্ষিতে অনেক শিশুই তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ সঠিকভাবে ঘটাতে পারছে না, ভাবতে পারছে না নিজের মতো করে। মনের বিষণœতা ও একাকীত্বতাকে দূর করতে প্রযুক্তিপণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং প্রযুক্তিপণ্য হয়ে উঠছে শিশুদের মন ভালো করার একমাত্র মাধ্যম।
আধুনিকায়নের যুগে শিশুরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকুক বা অনভ্যস্থ হোক, আমি কিন্তু মোটেও তেমনটা প্রত্যাশা করছি না। তবে শিশুদের প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের একটি পরিণত বয়স দরকার। শিশুবয়সে প্রযুক্তিপণ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ প্রাথমিক শিক্ষার পথকে অন্তরায় ফেলে দেবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যে হারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিডিও ক্লিপ দেখছে, তাতে করে তাদের মস্তিষ্ক ভিন্ন পথে প্রভাবিত হতে শুরু করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত সব ভিডিওই শিশুদের জন্য তৈরি করা নয়। বড়দের উপযোগী ভিডিওতেও তাদের চোখ যাচ্ছে, যা তাদের জন্য ভালো না কি মন্দ সেটা বিচারের সুযোগ ওদের কাছে নেই। এটির ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী যা হয়তো আমাদের অনেকেরই উপলব্ধির বাইরে।
আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, সংসারের কাজ সামলাতে গিয়ে সন্তানের হাতে ডিভাইস দিয়ে রাখেন অনেক মা। এমন চিত্রও চোখে পড়ে- কিছু কিছু সন্তান ডিভাইস সঙ্গে না রেখে মুখে খাবারই তুলতে চায় না। সকল মনোযোগ যেন মোবাইলের ভেতর! মূলত অভিভাবকদের ভুলে ও অসচেতনতার কারণে শিশুরা প্রযুক্তিপণ্যের দিকে ঝুঁকছে বেশি। শিশুর সামনে পরিবারের সদস্যদের মাত্রাতিরিক্ত ডিভাইসের ব্যবহার ওদের আকৃষ্ট করছে যে এর ভেতর না জানি কী আছে! অনেক বাবা-মাকেই আজকাল দেখা মেলে শিশুকে সঙ্গে নিয়ে মোবাইলের ভিডিওতে মত্ত হয়ে ওঠে। হাসির ভিডিওতে খিলখিল করে হাসতেও দেখা যায়। একবারও চিন্তা করে না যে এই সময়টাকে সন্তানকে ভিন্নভাবে দিতে পারি কিনা। যেটা থেকে সন্তানের এখনই শেখার বা বোঝার কোনো সুযোগ নেই, সেটাতে কেন ওদের উৎসাহিত করে তুলব? যে বয়সে শিশুরা মা-বাবার আদর-¯েœহ পেতে পেতে বড় হবে, মায়ের বলা গল্প শুনে কল্পনারাজ্যে ঘুরে আসবে, সে বয়সে কিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ক্লিপ দেখছে। একবার চিন্তা করতে পারছেন- যদি কোনোভাবে এসব শিশু ঐসব ভিডিওর বিষয়বস্তু মাথায় নিয়েই বড় হয়, তবে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠবে, তা কল্পনারও বাইরে।
শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে। পরিবারের বড় সদস্যরা কী করছে, সেদিকে ওদের নজর বেশি থাকে। বড়রা মোবাইল-কম্পিউটারে ভিডিও ক্লিপ দেখে হাসাহাসি করছে তো শিশুরাও সেদিকে মনোযোগ দেয় ও আগ্রহ দেখায়। তাহলে পরোক্ষভাবে পরিবারের মানুষজনই শিশুদের ভিন্নপথে পরিচালিত করছে। আজকাল এমনও দেখা যায়- পরিবারের অভিভাবকগণ অফিস থেকে ফিরে বিশ্রামের নিমিত্তে মোবাইলে উচ্চ শব্দে ভিডিও ক্লিপ দেখতে শুরু করে। ঘরে থাকা শিশুটিকে সময় দেওয়ার কথা মনে আনতেই পারে না। যে কারণে শিশুটি যেমন নিজেকে একাকীত্ব মনে করে, খেলার সাথী হিসেবে কাউকে খুঁজে পায় না, সেইসাথে অনুকরণ করতে গিয়ে প্রযুক্তিপণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আসলে এসব বিষয়ে শিশুদের দোষ দেওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না, সব দোষ বড়দের এবং তাদের অজ্ঞতাও দায়ী। একটি শিশুকে ছোট থেকে বড় হতে কোন পথ অনুসরণ করাতে হবে, তা সম্পন্ন নির্ভর করে বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর। শিশুকে নির্দিষ্ট সময় না দিয়ে মোবাইল হাতে তুলে দিয়ে ‘যা খুশি করুক, আমি বিশ্রাম নিই’ জাতীয় চিন্তাচেতনা থেকে শিশুরা পরিবারের সদস্যের থেকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেইসাথে মারাতœক এক পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুবয়সে ওদের কল্পনাজগৎকে সংর্কীণ করে তুলছে প্রযুক্তিপণ্য যার দায় পুরোপুরি বর্তায় পরিবারের সদস্যদের ওপর। তাই পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এই সচেতন হতে পরিবারের সবাইকে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে- এমনটাও না। একটা সময় টেলিভিশনের সামনে বসে সবাই একসাথে অনুষ্ঠান দেখা হতো। সেই দিন আর নেই। এখন যার যার হাতে মোবাইল। যে যার মতো করে বিনোদন উপভোগ করে থাকে। একসাথে যখন টেলিভিশনে কোনো অনুষ্ঠান দেখা হতো, তখন তা থাকতো পরীক্ষিত যে এটি সবার উপযোগী কিনা। আর এখন যার যার মতো করে ভিডিও কনটেন্ট দেখায় কেউ কারোটা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পাচ্ছে না। প্রাইভেসি ইস্যু এখন বড় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিশুরা কী দেখছে, কী শিখছে, সেটা দেখাভালের অধিকার প্রাইভেসি ইস্যুর বাইরে পড়ে, তা ভুলে যাচ্ছে অভিভাবক। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোংরা ভিডিও ক্লিপের ভীষণ ছড়াছড়ি। আর এসব ভিডিও ক্লিপ যেকাউকেই প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে, যার নেতিবাচক প্রভাব মাত্রাতিরিক্ত। শিশুদের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই। যুগবিচারে সবার হাতে হাতে মোবাইল-ফোন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও যোগাযোগের মান-উন্নয়নে এটির ভূমিকা অপরিসীম। বিপরীতে এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়েও ভাবনার সময় এসেছে এখন। এজন্য সচেতন হতে হবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। যে পরিবারে শিশুসদস্য আছে, সে পরিবারে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে হতে হবে সচেতন। প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে শিশুটি বড়দের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে কিনা, সেদিকে নজর দিতে হবে। নিজেদের ব্যস্ততার অজুহাতে মোবাইল-ফোন হাতে তুলে দিয়ে শিশুকে ভিন্ন একজগতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে আশস্ত¡ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে আমার সন্তানটি আধুনিকভাবে বড় হচ্ছে। যে সময়টা শিশুকে দেওয়া দরকার, সেটা দিতে হবে সৃজনশীল ও বুদ্ধিভিত্তিকভাবে। শিশুরা যাতে ভার্চুয়ালি নয়, প্রকৃতই বাইরের জগৎ সর্ম্পকে জানতে পারে, সে লক্ষ্যে শিশুদের নিয়ে ছুটির দিনে শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, লাইব্রেরিসহ নানান দর্শনীয় স্থান থেকে ঘুরিয়ে আনতে হবে। সুস্থ বিনোদন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আউট বই পড়ার দিকে অভ্যেস্থ করতে নতুন নতুন বই কিনে দিতে হবে।
আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আজকাল শিশুরা চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে পড়ছে। মা-বাবাও দায়সারাভাবে শিশুদের বড় করে তুলছে। শিশু যখন বাইরে ঘোরাঘুরির আবদার করছে, তখনই মোবাইল ডিভাইস হাতে তুলে দিয়ে শিশুকে সান্ত¦না দেওয়া হচ্ছে। কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে এই সংস্কৃতি চর্চা, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। আমরা শিশুদের এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বড় করছি, যা কোনোক্রমেই কল্যাণ বয়ে আনবে বলে আমার মনে হয় না। যে শিশু বুঝতেই শেখেনি ভবিষ্যৎ কী, সেই শিশুকেই কিনা আমরা ছেড়ে দিচ্ছি এক ভার্চুয়াল জগতের মোহমায়ায়। তাহলে তারা বড় হয়ে প্রকৃত মানবিক জগৎ সর্ম্পকে কতটুকু ওয়াকিবহাল হতে পারবে এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। আমাদের বুঝতে হবে, মানুষের প্রয়োজনবোধেই হাতে হাতে পৌঁছে যাবে প্রযুক্তিপণ্য। তাই উপযুক্ত সময় না হতেই কোনো শিশুর হাতে প্রযুক্তিপণ্য তুলে দিয়ে আধুনিক বানানোর নাম করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করার কোনো মানে হয় না।
লেখক : সাহিত্যিক, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার