আসন্ন ঈদুল ফিতরে রেলপথে ঘরমুখো মানুষের চাপ মোকাবিলায় রেকর্ড সংখ্যক কোচ মেরামত করা হচ্ছে নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ জনবল, বাজেট স্বল্পতা, উপকরণ সরবরাহসহ নানা সমস্যা নিয়েও এবারের ঈদযাত্রায় ১০০টি কোচ সংযুক্ত করতে যাচ্ছে কারখানাটি। এর মধ্যে রয়েছে ৮৩টি ব্রডগেজ ও ১৭টি মিটারগেজ কোচ। নানা সংকটের মধ্যেও চরম কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে কারখানাটির শ্রমিক-কর্মচারীদের। মেরামতকৃত এসব কোচ ঈদের বিশেষ ট্রেনগুলোতে সংযুক্ত করা হবে। রেলবহরে বাড়তি কোচগুলো যুক্ত হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পুরোনো ট্রেনকে নতুন করার কাজ চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি স্থাপন করে। সেই সময় সৈয়দপুর কারখানায় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। ধীরে ধীরে জনবল কমে যাওয়ার পরও এ কারখানায় প্রতিদিন একটি কোচ ও একটি ওয়াগন মেরামত করা হয়। এছাড়া রেলওয়ের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এখানে। কারখানাটির যান্ত্রিক শাখায় ২ হাজার ৮৫৯ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬২১ জন। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জিওএইচ, উৎপাদন মেশিন শপ, ক্যারেজ শপ, হুইল শপ, বগি শপ ও সিএইচআর শপ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া বগি মেরামতের কাজ চলছে। কেউ ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, কেউবা ব্যস্ত চাকা মেরামতে। আবার কেউ ওয়েল্ডিং ও কোচের সিট মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোথাও আবার মেরামত করা বগিকে নতুন করে রং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের। তবে, তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জনবল ও কাঁচামালের অভাবে পুরো কর্মযজ্ঞ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ চলছে কারখানার ২৪টি বিভাগে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া ৭০টি বগি চলে গেছে পাকশী ও লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাছে। ক্যারেজ শপের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি সুবাহান আলী বলেন, ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গাড়ির যাবতীয় কাজ করছি। অচল গাড়িকে আমরা সচল করে থাকি। আমাদের কাজ বেড়ে গেছে, আগে যে পরিমাণ আউটটার্ন যেত তার দ্বিগুণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের কষ্টের বিনিময়ে মানুষ শান্তিতে ঈদ করতে পারবে, ঘরে ফিরতে পারবে এটাই আমাদের সফলতা। কারখানাটির পেইন্ট শপের বাবু লাল বলেন, আমি কালো রংয়ের কাজ করি, গাড়ির বডিতে যত কালো রং আছে সব আমিসহ আরও পাঁচজন মিলে করি। আর ঈদের সময় কাজের চাপ থাকলেও তা আমরা করে যাচ্ছি। আরও যদি কাজ থাকে তবুও আমরা করবো। আমরা কাজকে ভয় করি না, কাজকে ভালোবাসি। ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য আমরা সুন্দরভাবে কাজ করে যাচ্ছি। একই শপের শহিদুল ইসলাম বলেন, কাজের চাপ প্রচুর, এত বেশি যে বলার মতো না। আমাদের লোক সংকট, যার কারণে আমরা আউটটার্ন ঠিকমরতা দিতে পারছি না। অল্প লোক নিয়ে গাড়ি আউটটার্ন দিচ্ছি আমরা। ঈদে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে যাবে, এটা আমাদের অনেক ভালো লাগবে। আমরা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। সেবা দেওয়াটাই আমাদের কর্ম। বগি শপের মিস্ত্রি মেহেদী হাসান বলেন, ট্রলি বের করে নতুন চাকা ফিটিং করে আবার সেটা গাড়িতে ফিটিং করি। ফিট করার পর গাড়ি আউটটার্ন দেই। এভাবে মাসে ১০ থেকে ১৫টি গাড়ি আউটটার্ন দেই। ঈদ উপলক্ষ্যে যে কাজ দেওয়া হবে সেটাই আমাদের করতে হবে। দশজনের কাজ দুইজনে করা লাগে। এই জায়গায় লোকবল নেই। লোকবল তো নিচ্ছে না। বগি শপের ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম বলেন, পহেলা মার্চ থেকে আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। টার্গেট ৪০ দিনে এক শ কোচ প্রস্তুত করা। এই টার্গেট পূরণে আমরা সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করি। কারখানায় অনেকগুলো শপ আছে। একটা শপ আরেকটা শপের উপর নির্ভরশীল। সবগুলো শপ সমন্বয় করে আমরা আউটটার্ন দেই। জিনিসটা এমন কেউ যদি একদিন মিস করে অন্যদিকে পিছিয়ে যেতে হয়। এজন্য আন্তরিকতার সঙ্গে সকাল থেকে আমাদের শ্রমিকরা রোজা রেখে পরিশ্রম করছে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, এবারের ঈদে নিরাপদে অতিরিক্ত যাত্রী গ্রামে এবং ঈদ শেষে যাত্রীদের নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া। ক্যারেজ শপের ইনচার্জ মমিনুল ইসলাম বলেন, ঈদ উপলক্ষ্যে ঘরমুখো যাত্রীদের একটা প্রত্যাশা ও চাপ থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা ১০০ কোচের লক্ষ্যমাত্রায় কাজ করছে। আমাদের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ কোচ আমরা আউটটার্ন দিতে সক্ষম হয়েছি। আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে বাকি ৩০ শতাংশ আউটটার্ন দিতে সক্ষম হবো। জিওএইচ শপের ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম বলেন, অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে আমরা আমাদের কাজগুলো করার চেষ্টা করি। এখানে মোট জনবল ১৩৯ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কাজ করছে মাত্র ৩৭ জন। এছাড়া কয়েকজন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে। আমরা অন্য সময়ে যে পরিমাণ কোচ আউটটার্ন দিয়ে থাকি তার দ্বিগুণ আমরা বর্তমানে হাতে নিয়েছি। ঈদ উপলক্ষ্যে যে ১০০টি কোচের টার্গেট রযেছে, তার মধ্যে আমরা ৭০টি কোচ ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পেরেছি। আগামী ১৩ বা ১৪ তারিখের মধ্যে বাকি কোচগুলো ডিভিশনে হস্তান্তর করতে পারব। কারখানার শিডিউল দপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ইনচার্জ) রুহুল আমিন রুবেল বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রার সুবিধার্থে ১০০ কোচ আউটটার্ন প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০টি কোচ মেরামত করে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩০টি কোচ আগামী ১৮ এপ্রিলের মধ্যে ডিভিশনে হস্তান্তর করা হবে। এই কোচগুলা পঞ্চগড়-ঢাকা, রাজশাহী-ঢাকা, চিলাহাটি-ঢাকা, খুলনা-ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা রুটে যে সকল ট্রেন রয়েছে সেগুলোতে সংযোজন করা হবে। তখন বেশি পরিমাণে যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। আমরা ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য অবদান রাখতে পারছি, এজন্য শুকরিয়া। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান বলেন, মার্চের ১ তারিখ থেকে এপ্রিলের ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমাদের ৪০টি কার্যদিবস রয়েছে। এই ৪০টি কার্যদিবসের মধ্যে আমরা মোট ১০০টি কোচ মেরামত করে অপারেটিং বিভাগকে হস্তান্তর করবো। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য সময় আমাদের যে সমস্যাগুলো থাকে সেই সমস্যাগুলো এখনো রয়েছে। কিন্তু ঈদের সময় যাতে যাত্রীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারে সেজন্য আমাদের শ্রমিকরা উৎফুল্ল হয়ে কাজ করছে। অনেক সময় তাদের কাজের জন্য বলার প্রয়োজন হলেও বর্তমানে স্বপ্রণোদিত হয়ে অতিরিক্ত কাজগুলো করছে।