রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়েছেন ছোট-বড় সবাই। বছর শেষে গঙ্গা দেবীকে প্রার্থনা জানিয়ে শুরু হলো পাহাড়ের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান বৈসাবির মূল আনুষ্ঠানিকতা। নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় বুধবার (১২ এপ্রিল) সকালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসায় বিভিন্ন বয়সের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও বৃদ্ধরা। এদিন ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুলবিজু উপলক্ষে শহরের রাজবনবিহার ঘাট, পলওয়েল পার্ক, কেরাণী পাহাড়, ভালেদী আদাম, আসামবস্তীসহ বিভিন্ন জায়গায় জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানিতে ফুল ভাসানো হয়। এছাড়া পৌর শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায়ও হ্রদের স্বচ্ছ নীল জলে ফুল ভাসিয়ে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায় গঙ্গা দেবীকে স্মরণ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এ সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি গ্রামগুলো। বুধবার চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হাঁড়িবসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ে সূচিকাজ। ঠিক ফুলবিজু নামে অভিহিত না হলেও এদিন প্রায় সব পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীই পানিতে ফুল ভাসানোর আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। উৎসবপ্রিয় পাহাড়িরা বছর শুরুতে উদযাপন করেন এ সামাজিক অনুষ্ঠান। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদা রীতিতে পালন করে এই উৎসব। তবে তাদের আনুষ্ঠানিকতা একই। উৎসবের প্রথম দিনে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের তরুণ তরুণীরা বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং কলাপাতা করে ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে, তাই একে বলা হয় ফুল বিজু। এসময় গঙ্গা দেবীর কাছে দেশ, জাতি ও সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রার্থনা করা হয়। পুরনো বছরের দুঃখ বেদনা পানিতে ভাসিয়ে নতুন বছরের সুন্দর জীবন কামনা করেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। শহরের রাজ বনবিহার ঘাটে হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে এক তরুণী বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্যতম একটি সামাজিক উৎসব হলো ফুল বিজু। ফুল বিজু দিয়ে আমাদের বিজু উৎসবের মূল সূচনা হয়। এ দিন আমরা গঙ্গা দেবীকে ফুল দেই। যাতে করে আমাদের সমগ্র দুঃখ কষ্ট মুছে যায় এবং নতুন বছরকে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করতে পারি। আরেক তরুণী বলেন, বছরের এ দিনগুলোতে আমরা বেশ আনন্দের মধ্য দিয়ে কাটাই। আজকে আমরা হ্রদের জলে ফুল ভাসিয়ে নতুন বছরের জন্য গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছি। কাল হচ্ছে আমাদের মূল বিজু। এদিন আমরা সব আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যাবো। এক তরুণ বলেন, হ্রদে ফুল ভাসিয়ে আমরা পুরানো বছরকে বিদায় জানালাম। একই সঙ্গে পুরানো বছরের সকল দুঃখ কষ্টকে ভুলে আগামী বছর যেন আনন্দে কাটাতে পারি সেই প্রার্থনা করেছি গঙ্গা দেবীর কাছে। সবাই যেন সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করতে পারি সেই প্রার্থনা করেছি। শহেরর কেরাণী পাহাড় এলাকায় রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ফুল ভাসানো অনুষ্ঠানে যোগ দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, আজ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবির তিনদিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পাহাড়ের বসবাসরত সমগ্র ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের আমি আমার রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈসাবির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি এই উৎসব আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করবে। বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব উপলক্ষে আমরা কিছুদিন আগ থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছি। আজ ফুল ভাসানেরা মধ্য দিয়ে আগামী তিনদিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সবাই যাতে নতুন বছর ভালোভাবে কাটাতে পারে সেই কামনা করি। আশা করছি আমরা কোন ধরনের সমস্যা ছাড়া উৎসব পালন করতে পারবো।