বাংলাদেশজুড়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন একমাত্র আলোচ্য বিষয়, আগামী সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকার যেসব অভিনব ব্যবস্থা করেছে, সে রকম কারচুপির কথা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথায়ও শোনা যায়নি। সেসব কথা বাংলাদেশীরা যেমন বলছেন, তেমনি বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেছেন, আগের রাতে পুলিশ দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা তিনি পৃথিবীর আর কোনো দেশে শোনেননি। শুনবেন কেমন করে? কারণ পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো যা খুশি তাই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় না। তার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আইন আছে। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে একসময় সাংবিধানিক আইন ছিল। যে আইন বহাল থাকলে যাকে খুশি তাকে নির্বাচন কমিশনের সদস্য করা সম্ভব হতো না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের পর অসৎ উদ্দেশ্যে সে ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে আওয়ামী লীগ যাকে ইচ্ছে তাকেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে পারে।
এই বশংবদ নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিকভাবেই আওয়ামী লোকদের দ্বারা গঠন করা হয়। এই পর্যন্ত তারা অযোগ্যতা ও মেরুদ-হীনতার নিকৃষ্টতম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালও একই গোত্রের লোক যদিও হাবিবুল আউয়ালের কথাবার্তা তুলনামূলকভাবে পরিশীলিত। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের সেবায় তিনি তার পূর্বসূরিদের চেয়ে কম যান না।
ইভিএমের ঘটনার কথাই বলা যায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য সব নির্বাচন কমিশনার একযোগে হুক্কাহুয়া করে উঠলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট হবে। কিন্তু লেঙ্গুর তুলে দেখল না যে, সেই সাধ্য নির্বাচন কমিশনের আছে কি না। ‘শুমার করিয়া’ দেখা গেল, ইভিএমে ভোট করার মতো যথেষ্টসংখ্যক মেশিন নেই। যা যাছে তা দিয়ে অর্ধেকসংখ্যক আসনে ভোট নেয়াও সম্ভব হবে না। উপরন্তু মেশিনগুলো বহু দিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সেগুলো মেরামত করতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দরকার। আবার ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে নতুন মেশিন কিনতে হবে। তার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান। কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সে অর্থের সংস্থান করা একেবারেই অসম্ভব।
ওবায়দুল কাদের বললেন, তাহলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করা হোক। নির্বাচন কমিশনাররা এই লাইনে কিছু দিন চুপচাপ থেকে শেষ পর্যন্ত তারাও বলতে থাকলেন যে, ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন হবে কিন্তু অধিক দামে কেনা মেশিনগুলো মেরামতের জন্য নতুন করে অর্থ বরাদ্দ হলো না নির্বাচন কমিশনের জন্য।
আওয়ামী লীগ ছাড়া সব বিরোধী দল একযোগে দাবি করতে থাকল যে, তারা এই নির্বাচন কমিশন মানেন না এবং ইভিএমের মাধ্যমে কোনো ভোট বাংলাদেশে হতে দেয়া হবে না। ফলে ইসি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো যে, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনেই ব্যালটে ভোট হবে। সিইসি হাবিবুল আউয়াল এমন একটা ভাব ধরলেন যে, তিনি বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়েই ইভিএমের বদলে ব্যালটে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন!
জাতীয় নির্বাচন তো আরো একটু দূরে। তার আগেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী মাসে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বিরোধী দল বর্তমান সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। সে দিক থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি হয়ও তবে তাতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দ্বিমুখী আচরণ একেবারে মুখ ব্যাদান করে প্রকাশিত হয়ে পড়ল।
অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন কাগজের ব্যালটে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচন ইভিএমেই করতে যাচ্ছে ইসি। কেন? নির্বাচন কমিশনকে সরকারের তরফ থেকে যখন যেভাবে নাচতে বলা হয় তখন সেভাবেই তারা তা-ধিন তা-ধিন নাচতে শুরু করেন। তাই এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।
তার উপর আছে, এই পাতানো নির্বাচনেও ঢাকঢাক গুড়গুড় অবস্থা। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যাপক ব্যবহার হবে।
আওয়ামী লীগেরই একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেন। তারা মারামারি করে রক্তারক্তি বাঁধাবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন চাইছে, তারা এতই যোগ্য যে, সিটি নির্বাচন একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে- সেটা দেখাতে। আর সে কারণেই প্রথম সিদ্ধান্ত এসেছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দেশের সব ধরনের নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহের কাজে সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ফলে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে পারবেন না গণমাধ্যমকর্মীরা।
পাশাপাশি নীতিমালার কোনো নির্দেশনা প্রতিপালন না করলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ইসি। নির্বাচন কমিশনের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ আশাদুল হক এই বিধি জারি করেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের বাহন হচ্ছে মোটরসাইকেল যা ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করাই প্রায় অসম্ভব।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের যাতায়াতের জন্য যৌক্তিক সংখ্যক স্টিকার দেয়া হবে। তবে মোটরসাইকেল ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে না। আগের নির্বাচন কমিশনও একই ধরনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এবারে হাবিবুল আউয়ালের কমিশন একেবারে আইন করে গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। তা ছাড়া এমন সব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে সাংবাদিকদের নির্বাচন কভার করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নীতিমালায় সাংবাদিক বলতে ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত ও নিয়মিত প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত অনুমোদিত টেলিভিশন চ্যানেল, অনুমোদিত অনলাইন নিউজপোর্টাল, অনুমোদিত ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিভিশন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, তথ্য অধিদফতরের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে আসা সাংবাদিকদের পাশ দেয়া হবে। নির্বাচন কাভার করতে যেই চান না কেন তাকে সাংবাদিক কার্ড দেবেন রিটার্নিং অফিসার বা তার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কতজন সাংবাদিককে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হলো, তাদের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, সাংবাদিক পরিচয়পত্র/পিআইডি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট ও এক কপি স্ট্যাম্প সাইজের রঙিন ছবি আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের পালনীয় নির্দেশনাবলি
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বৈধ কার্ডধারী সাংবাদিক সরাসরি ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর প্রিজাইডিং অফিসারকে অবহিত করে ভোটগ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ করতে পারবেন। তবে কোনো ক্রমেই গোপন কক্ষের ছবি ধারণ করতে পারবেন না।
একই সাথে দুই-এর অধিক মিডিয়া সাংবাদিক একই ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না এবং ১০ মিনিটের বেশি ভোটকক্ষে থাকতে পারবেন না। ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, নির্বাচনী অ্যাজেন্ট বা ভোটারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে পারবেন না। ভোট কক্ষের ভেতর থেকে কোনোভাবেই সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন না। সাংবাদিকরা ভোট গণনা দেখতে পারবেন। ছবি নিতে পারবেন। তবে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন না।
ইসির নীতিমালায় বলা হয়, এসব নির্দেশ পালন না করলে তার সাংবাদিক কার্ড বাতিল করা হবে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই নীতিমালা নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় সংসদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন বা উপ-নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হবে।
এ সম্পর্কে টিআইবি বলেছে, প্রিজাইডিং অফিসারকে অবহিত করে নির্বাচনের তথ্য সংগ্রহের যে বিধান রাখা হয়েছে তা গণমাধ্যমকর্মীদের আজ্ঞাবহ করে রাখার শামিল। অর্থাৎ ইসির ইচ্ছার বাইরে কেউ কোনো কাজ করতে পারবেন না।
এর আগে ২০১৪ সালে আমরা ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছি, ২০১৮ সালে দেখেছি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের রাতে সরকারি দলের পক্ষে ব্যালট বাক্স ভরে রাখতে। হাবিবুল আউয়াল এবার এক সৃষ্টিশীল কায়দা গ্রহণ করেছেন। ভোটারে লাইন থাকবে, ভেতরে আজ্ঞাবহ সাংবাদিকদের আনাগোনা থাকবে। ধারণা করি, ‘ডাকাত’ও থাকবে। কিন্তু তার কোনো কিছুই মিডিয়ায় আসবে না। ফলে নির্বাচন খুবই শান্তিপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়ে যাবে। অতএব হে নির্বাচন কমিশন, আপনারা বিসমিল্লাহ বলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নাটক শুরু করে দিন। লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক rezwansiddiqui@yahoo.com