বাংলাদেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে আগামী ১ জুন। রাষ্ট্রপতি এরইমধ্যে আগামী ৩১ মে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন ডেকেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ১ জুন জাতীয় সংসদে সরকারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে বাজেটের এই আকার পরিবর্তনও হতে পারে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে ১২ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৯ জুন তিনি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয় সংবলিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন এডিপি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি এবং মূল এডিপির তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরেও দেশের সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জানা গেছে, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। এগুলো মোকাবিলা ও সমন্বয় করে নির্বাচনের বছরে কীভাবে ব্যয় সমন্বয় করা যাবে, তা নিয়ে বাজেটের কাজ প্রায় চূড়ান্ত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আগামী বছরের জন্য চূড়ান্ত করা বাজেটে অনুমোদন দিয়েছেন।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১ জুন অনুষ্ঠিত হবে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক। জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে এই বিশেষ বৈঠক। মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে নতুন অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেওয়া হবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নতুন অর্থবছরের বাজেটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের জন্য সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করবেন। সময়ক্ষেপণ না করতে রাষ্ট্রপতি সেদিন বঙ্গভবনের পরিবর্তে জাতীয় সংসদ ভবনের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে অফিস করবেন। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করবেন। পরে স্পিকারের অনুমতি সাপেক্ষে জাতীয় সংসদে সরকার আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ৭ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন আগামী ১ জুন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ১ জুন বাজেট উপস্থাপন করা হচ্ছে জাতীয় সংসদে। এর আগে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন ১ জুন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দেশের প্রথম বাজেট (৭৮৬ কোটি টাকা) জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন ৩০ জুন।
উল্লেখ্য, এ বছর জুনের শেষ দিকে ঈদুল আজহার ছুটি থাকবে। তাই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পাস হতে পারে জুন মাসের শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে। জানা গেছে, আগামী ২৫ জুন রবিবার সংসদে বাজেট পাস হতে পারে। যদিও জুনের ১ তারিখে বাজেট উপস্থাপিত হলে আলোচনার সময় বেশি পাওয়া যায়। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নতুন অর্থবছরে বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা পরে সংশোধন করে কিছুটা কমানো হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় বৈঠক ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তবে বাজেট চূড়ান্ত করার আগে বাজেট ঘাটতি একটু বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার একটু কমিয়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ করা হতে পারে। জানা গেছে, সার্বিকভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের সুদ ব্যয়ে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এটি বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। বিপুল ভর্তুকির মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর কৃষি খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। এদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকারের শেষ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নতুন করে ৭ লাখ ৩৫ হাজার জন বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয়।
এদিকে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা নাকি ইনক্রিমেন্ট থাকছে এ নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সরকারি কর্মচারীরা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন মহার্ঘ ভাতা নয়, তারা ইনক্রিমেন্ট চান। অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা থাকছে না। অপরদিকে সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- নি¤œ বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল যেন বিষয়টি বিবেচনায় নেয়, এমন অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে শতকরা প্রায় ৪০ শতাংশ। সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বছর বার্ষিক একটি ইনক্রিমেন্ট হিসেবে বেতন বেড়েছে মাত্র ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অথচ টাকার অঙ্কে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার টাকা, বা তারও বেশি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, সরকারকে ২০১৮ সালের সুপারিশ অনুযায়ী, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আপাতত তিনটি ‘বিশেষ ইনক্রিমেন্ট’ ও ‘নবম পে-কমিশন’ গঠনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দিতে হবে। কারণ, বর্তমান বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় নি¤œ বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এটাকে নির্বাচনি বাজেটও বলা যায়। ৮ বছর পর এবারের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সব মহলে আলোচনা হচ্ছে। তবে নতুন পে-স্কেল নয়, মহার্ঘ ভাতার বিষয়টি নিয়ে চলছে এই আলোচনা। অনেকের ধারণা, নির্বাচনি বছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য হয়তো কোনও সুখবর থাকতে পারে। সরকারপ্রধান হয়তো আলাদাভাবে সেটি ঘোষণা করবেন।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য তা বাড়িয়ে ৫ লাখ কোটি টাকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেই (এনবিআর) সংগ্রহ করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।-বাংলাট্রিবিউন