এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু ঢাকায় দেড় মাসে (১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল ২০২৩ খ্রি.) অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে ১৬টি। ফায়ার সার্ভিসের সূত্র মতে, ২০২২ সালে অগ্নিদুর্ঘটনা ছিল ২৪ হাজার ১০২টি। অতি সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের সবচেয়ে সন্নিকটে অবস্থিত বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকা-ে এবং নিউমার্কেটে অসংখ্য দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। অগ্নিকা-ে যখন সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যায়, তখন অগ্নিকা–পরবর্তী তদন্ত করে সঠিক কারণ বের করা সম্ভব হয় না। ফায়ার সার্ভিসের সূত্র মতে, বৈদ্যুতিক বিভ্রাট থেকে ৩৮ শতাংশ, জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ১৬ শতাংশ, চুলা থেকে ১৪ শতাংশ, গ্যাসের লাইন থেকে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে ২৯ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ফায়ার সার্ভিস সদস দপ্তরের সবচেয়ে সন্নিকটে ট্রাফিক জ্যামও ছিল না, ভোরবেলাতে সৃষ্ট অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেকটি স্থাপনায় নিজস্ব ‘ফায়ার ফাইটিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ থাকা অপরিহার্য। প্রবাদ আছে যে, ‘৫ মিনিটের মধ্যে অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ৫ ঘণ্টায়ও সম্ভব নয়’। সেজন্য প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু ফায়ার সার্ভিস দপ্তরের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না, দুর্ঘটনার সূত্রপাত যাতে না হয়, তা অনেকগুলো দপ্তরের যথাযথ দায়িত্বের ওপর বর্তায়। দপ্তরসমূহ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
অতি সম্প্রতি এয়ার কন্ডিশনার থেকে দুর্ঘটনার কথা প্রায় শোনা যায়। আসলেই কি এয়ার কন্ডিশনার কম্প্রেশার এতই শক্তিশালী যে, ভবনের দেওয়াল বা ছাদ উড়ে যাবে? ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। মোটেও সম্ভব নয়। দেশে অধিকাংশই স্প্লিট টাইপ এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যার কম্প্রেশার আউট ডোর ইউনিটে অর্থাৎ বাহিরে স্থাপন করা থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে, যেমন নি¤œমানের কম্প্রেশার, নকল ও নি¤œমানের রেফ্রিজারেন্ট (গ্যাস), পাইপ ব্লক, ভোল্টেজের তারতম্য, পাইপ ব্লক, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, থার্মোস্ট্যাট, কক্ষের আকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যতার জন্য কম্প্রেশার ফেটে যেতে পারেÍ যা থেকে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তবে অগ্নিকা-ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যার জন্য ইনডোর/আউটডোর অংশের তৎসংলগ্ন এলাকার দাহ্য পদার্থ বা অগ্নিকা-ে সহায়তামূলক কোনো ডেকোরেশন না থাকা আবশ্যক। এসি ব্যবহার থেকে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই, পেশাজীবী অভিজ্ঞ প্রকৌশলী দ্বারা এসি নির্বাচন ও স্থাপন করার মাধ্যমে দূষিত নয়, বিশুদ্ধ শীতল বাতাস গ্রহণ করুন। বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করুন।
রাজউকের দায়দায়িত্ব আমাদের সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। রাজউকের প্রকৌশল শাখা, অনেকগুলো শাখার মধ্যে একটি শাখা। প্রকৌশলীর সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ভবন নির্মাণের অভিজ্ঞতাও তুলনামূলক কম। অতি সম্প্রতি উত্তরায় কতগুলো ভবন নির্মাণ করে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজউকের কোনো বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক প্রকৌশলী ভবন নকশা অনুমোদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। রাজউক প্ল্যান পাশ করার ক্ষেত্রে মূলত আর্কিটেক্ট ডিজাইন, ফায়ার ও স্ট্রাকচার ডিজাইনের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। রাজউকের মূল ভবনেই নিয়ম মোতাবেক অগ্নিনিরাপত্তা-ব্যবস্থা কি রয়েছে? রয়েছে কি ডিটেকশন সিস্টেম? রেকর্ড রুম, সার্ভার রুম ও কম্পিউটার রুমে কি গ্যাস সাপশ্রেন সিস্টেম রয়েছে? কোনো নকশা অনুমোদনের আগে দক্ষ পেশাজীবী বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক পরামর্শকের প্রণীত নকশা চেয়েছেন? বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক দুর্ঘটনার মূল উৎপত্তি এখান থেকেই। মাঠপর্যায়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার মতো সক্ষমতা বা জনবল রয়েছে কি না, তা বিবেচ্য বিষয়।
অন্যদিকে ভবনের মালিক, আর্কিটেক্ট ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা রয়েছে। ভবনের মালিকগণ ভবন নির্মাণের শুরুতেই আর্কিটেক্টের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আর্কিটেক্ট রাজউক থেকে প্ল্যান পাশ করার জন্য নকশা করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক প্রকৌশলীগণের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। পরবর্তী সময়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োজিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমারত নির্মাণের শেষ পর্যায়ে বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক প্রকৌশলী নিয়োজিত হয়। পরবর্তী সময়ে বৈঃ/যাঃ কাজটি কোনো প্রকারে জোড়াতালি দিয়ে সম্পন্ন করে থাকে। যার জন্য সুউচ্চ ভবনের বাহির দেওয়ালে বহুসংখ্যক এসির আউটডোর লিফেটর সামনে দীর্ঘলাইন পরিলক্ষিত হয়। এতে বিদ্যুৎশক্তির অপচয় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহু অংশে বৃদ্ধি পায়।
বিদ্যুৎ কাজের রক্ষণাবেক্ষণের ভয়াবহতা বিবেচনা না করে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা করাতে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে। অথচ উন্নত বিশ্বে ভবন নির্মাণের শুরুতেই এমইপি পরামর্শক নিয়োজিত করে থাকে।
বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহেরও দায়দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। পিডিবি, ডেসা, ডেসকো, আরইবি, বৈদ্যুতিক লাইন্সেসিং বোর্ড প্রভৃতি ভবনে বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্য ভবনের অভ্যন্তরীণ ওয়ারিংয়ের নকশা নিয়ে থাকেনÍযা মাঠ পর্যায়ে যথাযথ পরীক্ষানিরীক্ষা করা হলে দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে। তাহলে ঝুলন্ত তার, ওপেন তার, ওভার লোড, শট সার্কিট প্রভৃতি থেকে দুর্ঘটনা বহুলাংশে হ্রাস করা যেত। সুউচ্চ ভবনের সবগুলো মিটার নিচতলায় এক জায়গায় করার কারণে তারের জঙ্গলের সৃষ্টি হয়, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের মতো জোনালভিত্তিক বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা করা হলে অথবা অনুমতি প্রদান করা হলে একই স্থানে বৈদ্যুতিক তারের কু-লী পরিহার করা যেতে পারে। আরেকটি সমস্যা হলোÍনকল ও নি¤œমানের বৈদ্যুতিক তার ও মালামাল বাজারে সয়লাব। নকল ও নি¤œমানের বৈদ্যুতিকসামগ্রী অত্যন্ত বিপজ্জনকÍযা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
গ্যাস কোম্পানিসমূহেরও দায়িত্ব রয়েছে। আবদ্ধ ফ্ল্যাটে রান্নাঘরের গ্যাস লিকেজ অগ্নির উৎস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেÍযা অতিসম্প্রতি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে এবং ঘটছে। রান্নাঘরে যথাযথ ভেন্টিলেশন না থাকাতে এবং অসতর্কতার কারণে প্রায়শ ঘটছে। গৃহিণীর পক্ষে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে গ্যাস কোম্পানি রান্নাঘরগুলোতে গ্যাস ডিকটেটর স্থাপনের ব্যবস্থা করতে পারেন। সিলিন্ডারের ক্ষেত্রেও হাইপ্রেশার রিলিজ ভাল্ভ নিয়মিত পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
অতি সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস ঢাকা শহরের প্রায় দেড় হাজারের বেশি ভবন অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে। পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ কি নিয়েছেন? এসব ভবনের গ্যাসলাইন ও বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম, অপ্রশস্ত রাস্তা, বিশৃঙ্খলা ও ইচ্ছুক জনতার কারণে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম আধঘণ্টা ফায়ার ফাইট করার নিজস্ব ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল রাখা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
ভবনের দুর্ঘটনা হ্রাস বা প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে প্রকৌশল সংস্থার মধ্যে একমাত্র গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবন নির্মাণের প্রায় ১৫০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং সব প্রকৌশল শাখার বিশেষজ্ঞ রয়েছে। যেমন স্থাপত্য, অবকাঠামো নকশা, বৈদ্যুতিক/যান্ত্রিক নকশা, প্লাম্বিং প্রভৃতি কাজের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার মাঠ পর্যায়ে রয়েছে। তাদেরকে কাজে লাগানো যায় কি না বিশেষজ্ঞদের মতামতের মাধ্যমে সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। অথবা ভবন নির্মাণ সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট সব শাখার প্রকৌশলীগণ নিয়ে পৃথক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। যাদের ওপর দায়দায়িত্ব অর্পণ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়। প্রত্যেকটি ভবনই হোক নিরাপদ ও দুর্ঘটনামুক্তÍএই কামনা করি। লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী