এ যেন লিচুর রাজ্য। যেদিকে চোখ যায় লিচু আর লিচু। লিচুর ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ। গোলাপরাঙা পাকা লিচুর ভারে নুয়ে পড়েছে অনেক গাছ। ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে তুলে খাওয়া যায়। লিচু কিনতে ও বাগানে ঘুরে বেড়াতে দূর-দূরান্তের লোকজনও ছুটছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। কেউ ছবি তুলছে, কেউ গাছ থেকে কিনে নিচ্ছে পছন্দের লিচু। সব মিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম। গ্রামের প্রবেশ পথেই দেখা মিলবে রাস্তার দুপাশে সারি সারি লিচু গাছ। হাজার হাজার লিচু থোকায় থোকায় ঝুলছে গাছগুলোতে। লাল টকটকে পাঁকা পাঁকা লিচু দেখলে যে কারো খেতে লোভ জাগবে। লিচু চাষ করেই দেশখ্যাত মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম, স্বাবলম্বী এখানকার লিচু চাষিরা। লিচু চাষে ভাগ্য ফিরেছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে হাজারও মানুষের। কম চাষে লাভ বেশি, তাই দিনদিন লিচু চাষে আগ্রহ বাড়ছে এখানকার চাষিদের।
সুস্বাদু, রসালো ও সুন্দর ঘ্রাণ- এ তিন কারণে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ্যাতি দেশজুড়ে। এবার লিচুর বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি তারা। এখন চলছে লিচু সংগ্রহ ও বিপণনের কাজ। সবমিলিয়ে এ মৌসুমে মঙ্গলবাড়িয়ায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা করছে কৃষিবিভাগ। দম ফেলারও সময় নেই লিচু চাষি ও পাইকারদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লিচু সংগ্রহ ও বিক্রির কাজে ব্যস্ত সবাই।
স্থানীয়রা বলছেন, লিচুর হাত ধরেই তাদের জীবনে এসেছে সচ্ছলতা। বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়া ও আশপাশের এলাকায় আট থেকে দশ হাজার ফলবতী লিচুগাছ রয়েছে। এ খাত থেকে লাভবান হচ্ছেন পাইকাররাও। তারা মৌসুমের শুরুতে এক বছরের জন্য কিনে নেন কৃষকের অনেক গাছ। পরে বেশি দামে বিক্রি করেন গাছের উৎপাদিত ফল। প্রথম উদ্যোক্তা ও বাগান মালিক ও লিচু চাষি তৌহিদুল ইসলাম (৬৫) বলেন, স্বাধীনতার পর আমিই প্রথম এ গ্রামে লিচু চাষ শুরু করি। স্থানীয় এক দারোগা চীন থেকে একটি গাছের চারা তার বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন। তারপর আমি শুরু করি বাণিজ্যিকভাবে। এরপর যতই দিন গড়াচ্ছে এ গ্রামে লিচুর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ একবার এ চারা রোপণ করার পর সঠিক পরিচর্যা হলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাড়তি কোন খরচ নেই, তাই এখানকার স্থানীয় কৃষক লিচু চাষে ঝুঁকছেন।
নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তা জুবায়ের হোসেন তামিম (২২) জানান, আমাদের কয়েকটি লিচু বাগান রয়েছে। যেখানে আমার বাপ-দাদারা আগে লিচু চাষ করেছেন। আমি ছোট থেকেই তাদের কাছ থেকে লিচু চাষ শিখে এখন পড়াশোনার পাশাপাশি লিচু চাষ করছি। তাছাড়া আমাদের গ্রামের তরুণ প্রজন্মকেও আমরা লিচু চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।কারণ লিচু চাষে তেমন কোন খরচ নেই। একবার চারা রোপণ করার পর শুধু সঠিক পরিচর্যা করাই মূল কাজ। এ গ্রামের মাটি লিচু চাষের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী ও উর্বর। মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু আকারে বড় হয়। এবার একশ লিচু বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আটশ টাকায়।
ঢাকা উত্তরা ৭নং সেক্টর থেকে লিচু বাগান ঘুরে দেখতে ও লিচু সংগ্রহ করতে এসেছেন মোহাম্মদ জামিল মাহমুদ। তিনি বলেন, আমি এখানে প্রথমবার এসেছি আমি এমন বাগান দেখে মুগ্ধ। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু লাল টসটসে পাকা লিচু। এখানকার লিচুর বড় গুণ গন্ধ আর স্বাদ। বাজারে বিভিন্ন জাতের লিচু পাওয়া গেলেও এ লিচুটির মাঝে একটা বিশেষত্ব আছে। ইচ্ছে আছে, দুই হাজার লিচু পরিবারের সবার জন্য নিয়ে যাবো।
স্থানীয় লিচু ক্রেতা আজহারুল ইসলাম। বাড়িতে মেহমান এসেছে তাই মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু কিনতে এসেছেন। তিনি জানান, এখানকার লিচু স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। আমি দুটি গাছ চুক্তি করেছি, যা লিচু পাওয়া যাবে সব কিনে নিয়ে যাবো। প্রতিবারই আমি এসময়টাতে এখানে এসে পছন্দমত গাছ দেখে দাম-দর করে লিচু নিয়ে যাই। এবার প্রতি একশ লিচুর দাম পড়েছে সাতশ টাকা করে। তবে আকৃতিভেদে দাম উঠানামা করে। পাকুন্দিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ নূর-ই-আলম বলেন, স্থানীয় প্রবীণদের ধারণা, প্রায় দুইশ বছর আগে এখানে লিচু চাষ শুরু হয়। প্রথমে এখানকার মানুষ নিজেদের বাড়ির আঙিনায় লিচুর চারা রোপণ করলেও বিগত কয়েক দশক ধরে তা বাণিজ্যিকভাবে প্রসারিত হয়েছে। এমনকি মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে লিচুর চাষ দেখে আশপাশের এলাকা নারান্দি, কুমারপুর, হোসেন্দি ও শ্রীরামদি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে লিচুর চাষাবাদ। এ বছর লিচু বিক্রি করে কৃষকরা আট থেকে দশ কোটি টাকা আয় করবেন বলে ধারণা করছেন কৃষি অফিসার।