উন্নয়ন এবং সুখ কি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, নাকি বিপরীতমুখী অবস্থানে থাকেÍএ নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণার অন্ত নেই। অনেকেই মনে করেন, উন্নয়ন অর্জিত হলেই সুখ আপনাআপনি ধরা দেয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, উন্নয়ন কখনোই সুখ নিশ্চিত করতে পারে না। একসময় আমাদের দেশে ‘গণতন্ত্র, নাকি উন্নয়ন’ কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এমন একটি বিতর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে। যারা এই বিতর্কের উদ্ভাবক তারা বোঝাতে চাইতেন, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিলেও ক্ষতি নেই। দেশ উন্নত হলে একসময় গণতন্ত্রও আপনাআপনি এসে ধরা দেবে। কিন্তু সেই বিতর্ক বেশিদূর এগোতে পারেনি। আরেক দল সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, আমাদের গণতন্ত্রও চাই, উন্নয়নও চাই। উন্নয়নবিহীন গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়ন উভয়ই অর্থহীন। গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের কোনো বিরোধ নেই। দুটিই পরস্পর সহযাত্রী। ঠিক তেমনি উন্নয়ন এবং সুখের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। উন্নয়ন ও সুখ পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। তবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলি আর সামাজিক উন্নয়নই বলি, সবকিছুর লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সুখ নিশ্চিত করা। সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে সুখ এবং উন্নয়ন পরস্পর হাত ধরে চলা। আমরা যদি উন্নত এবং সুখী-সমৃদ্ধ দেশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, তারা উন্নয়নের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুখ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। সুখ একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা। তবে সুখের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনগণের জন্য সুখ নিশ্চিত করা। মানুষ সুখের জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারে। আর জনগণের জন্য সুখ নিশ্চিত করার একটি উপায় হচ্ছে অর্জিত উন্নয়নের সুফল সবার জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিকে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। কোনো কারণে দেশের উন্নয়নের সুফল যদি সামান্য কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ, যারা ন্যায্যতার ভিত্তিতে উন্নয়নের সুফল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত, তারা ক্ষুব্ধ হয়। একসময় এই সংক্ষুব্ধ মানুষগুলো রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিশ্বে এমন অনেক দেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যারা অর্থনৈতিক দিক থেকে পর্যাপ্ত উন্নয়ন অর্জন করছে; কিন্তু তার পরও সাধারণ মানুষ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। এর কারণ হলো, সেই দেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিগণ শুধু উন্নয়ন অর্জনের দিকেই দৃষ্টি দিয়েছে, সেই উন্নয়ন কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বা কারা সুবিধা নিচ্ছে, কাদের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে উন্নয়নের সুফল, তা তাদের বিবেচনায় গুরুত্ব পায়নি।
বাংলাদেশ গত ১২/১৩ বছরে যেভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করেছে, আগের কোনো সময়ে তা সম্ভব হয়নি। এটা আমাদের যেমন স্বীকার করতেই হবে, তেমনি উন্নয়নের সুফল জনগণ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারছে কি না, তা নিয়ে যে-কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট কয়েক বছর আগে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ছিল সহনীয় পর্যায়ে। এখন তা অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে আগামী কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের ধনবৈষম্য বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। কয়েক বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আজ থেকে ২০ বছর আগে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের হার ছিল ১২ শতাংশ। এখন তা ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিষয়টির প্রতি দেশের বিশিষ্ট এক অর্থনীতিবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত ভালো একটি সংবাদ। কিন্তু যারা নতুনভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন, তারা কি সৎপথে অর্জিত সম্পদ দ্বারা এই সাফল্য অর্জন করেছেন, নাকি দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ওপরে উঠেছেন, সেটাও দেখার বিষয়। তিনি আরো বলেন, দেশে শত শত কোটিপতি রয়েছেন, যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একজন চাকরিজীবী, তিনি যত বড় পদেই থাকুন না কেন, তিনি যে বেতন এবং ভাতা পান তাতে স্ট্যাটাস অনুযায়ী তার পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হওয়ার কথা। তার এই বক্তব্য ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একজন মানুষ বিত্ত অর্জন করুক, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক, এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি যদি দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অন্যের ‘হক’ নষ্ট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন, তাহলে আপত্তি জানাতে হবে নিশ্চয়ই। সাধারণ একজন মানুষ যিনি সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে অর্থোপার্জন করেন। তিনি যদি দেখেন তারই সমপর্যায়ের আর একজন মানুষ দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন, তাহলে তার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হতেই পারে। তার সুখ বিনষ্ট হতে পারে।
আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেছি ঠিকই; কিন্তু সবার জন্য সুখ নিশ্চিত করতে পারিনি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর ট্রাক সেল কেন্দ্রে গেলেই অনুধাবন করা যায়, মানুষ কতটা কষ্টে আছে। সরকার দরিদ্র মানুষের জন্য তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই মহতি উদ্যোগকে কীভাবে বিতর্কিত এবং ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তার একটি সংবাদ কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যাদের নামে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের জন্য কার্ড ইস্যু করা হয়েছে তার মধ্যে ৮ লাখই ভুয়া। এদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন করে ৬ লাখ দরিদ্র মানুষের নাম তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। পুরোনো তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বিত্তবান মানুষ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের আত্মীয়স্বজন, এমনকি মৃত ব্যক্তির নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপযুক্তের মাপকাঠিতে যারা টেকেনি তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা এদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাদের জন্য কি কোনো শস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
জাতিসংঘ প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। এতে বিশ্বের কোন দেশের মানুষ কতটা সুখী তার একটি ধারণা দেওয়া হয়। উন্নয়নের কয়েকটি সূচককে বিবেচনায় নিয়ে এই রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়। এগুলো হচ্ছে মাথাপিছু গড় আয়, সামাজিক বন্ধন ও সহায়তা, সুস্থ আয়ুর প্রত্যাশা, জৈবনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, দানশীলতা ও ঔদার্য এবং দুর্নীতির ধারণাসূচক। ২০২৩ সালের জন্য জাতিসংঘ প্রণীত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট, ২০২৩-এর ১৩৭টি দেশকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১১৮তম। বাংলাদেশ পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। সুখী রাষ্ট্রের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান ২৬তম। তার পরও তারা জনগণের সুখ নিশ্চিত করার জন্য সুখীবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন করেছে। দেশটির মানুষের গড় জাতীয় আয় ৪৮ হাজার মার্কিন ডলার। মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ই যদি উন্নয়নের পরিমাপক হতো এবং মানুষের সুখ নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে তো তাদের এ ধরনের মন্ত্রণালয় স্থাপনের প্রয়োজন হতো না। সাধারণভাবে একটি দেশের উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, জনগণের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়, বেকারত্বের হার ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো কখনোই উন্নয়ন এবং সুখের সঠিক পরিমাপক হতে পারে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নানাভাবে হতে পারে। কেউ একজন দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিত্ত অর্জন করলে সেই অর্থ কিন্তু কোনো না কোনোভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হয়ে জিডিপির পরিমাণ এবং প্রবৃদ্ধিকে স্ফীত করে তোলে।
২০২২ সালে বাংলাদেশের গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্টের পরিমাণ ছিল ২৯৬ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমতুল্য বাংলাদেশি ৩১ হাজার ৫২১ বিলিয়ন টাকা। জিএনপি এবং জিডিপি নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অভ্যন্তরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় তার আর্থিক মূল্যই হচ্ছে জিডিপি। আর জিডিপির সঙ্গে রেমিট্যান্স, বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি যোগ হলে তাকে বলা হয় জিএনপি। জিএনপি সব সময়ই জিডিপির চেয়ে বেশি হয়। জিএনপিকে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটাই জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয়। কিন্তু এই জাতীয় আয় হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। এটা কখনোই মাথাপিছু জাতীয় আয় গণনার সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত আয়ের সঠিক চিত্র প্রতিভাত হয়ে ওঠে না। এমন হিসাবায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে উভয়ের প্রতিই অবিচার করা হয়। এ ধরনের হিসাবায়ন পদ্ধতি কোনোভাবেই মানুষের সঠিক আর্থিক অবস্থার নির্দেশক নয়। বলা হয়, অর্থই অনর্থের মূল। কিন্তু অর্থ ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। এটাই বাস্তবতা। অর্থ মানুষের জন্য নিশ্চিত সুখের বন্দোবস্ত করে না ঠিকই, কিন্তু অর্থ ছাড়া সুখ পাওয়া যায় না, এটাও সত্যি। আমাদের উন্নয়নের মূল উপলক্ষ্য হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের জন্য সর্বোত্তম সুখের নিশ্চয়তা বিধান করা। (দৈনিক ইত্তেফােেকর সৌজন্যে) লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড