বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন এখনো শুরু হয়নি এবং চলমান এই সংকট ক্রমশ একটা দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং দেশব্যাপী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ২০২০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে মিলে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করে। এনইউজি’র সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এখন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র দলগুলোর সাথে মিলে মিয়ানমার জুড়ে সেনাবাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে কিছুটা আশার সঞ্চার হয় যখন এএ ও এনইউজি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের বিবৃতি প্রকাশ করে। এ ধরনের রাজনৈতিক স্বীকৃতি ছিল রোহিঙ্গাদের জন্য একটা বড় অর্জন।
২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল, এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ সফলতার সাথে রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক পরিম-লের বিভিন্ন আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে এবং এই সংকটে বাংলাদেশের ভূমিকা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদেশগুলো বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জন্য গত ছয় বছর ধরে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে। সময়ের সাথে সাথে ত্রান সহায়তার পরিমান কমতে থাকলেও প্রতি বছর ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে, জনসংখ্যার এই বাড়তি চাপ মোকাবেলা ক্রমেই মানবিক সহায়তার উপর আরও চাপ ফেলছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের তেমন কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়াতে দীর্ঘ দিন ধরে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। গত ৫ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, পুলিশের ওপর হামলা, হত্যা ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে ২ হাজার ৪৩৮টি বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়েছে।
ক্যাম্পের মধ্যে এসব হত্যাকা-ের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা। মিয়ানমার থেকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে মানব পাচার ও অবৈধভাবে মেথামফেটামিন বা ইয়াবা পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ক্যাম্পগুলোতে স্থিতিশীলতা ফিরে না এলে সংগঠিত অপরাধ দেশের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে এবং সামনের দিনগুলোতে আরও নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করবে। দিন যতই যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে, স্থানীয়রা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাতের বেলায় সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের আতংকে রাত কাটে। ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মানবিক সেবায় দেশ-বিদেশের শতাধিক সংস্থার ২০ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি ক্যাম্পে কাজ করতে যাওয়া এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অপহরণ, খুন ও আরসাসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীর হুমকির কারনে ২০টির বেশি এনজিও ক্যাম্পগুলোতে তাঁদের সেবা কার্যক্রম সীমিত রেখেছে এবং কয়েকটি এনজিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় কৃষকদের অপহরণ করে দুর্গম জায়গায় নিয়ে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করছে এ ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় জনগণও আতঙ্কে রয়েছে। দ্রুত এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে জননিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর উপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল, পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও জাপান এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, জাতিসংঘ ও জাপানের পর ভাসানচর প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আর ও বেশি রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করতে আগ্রহী। ১৭ ফেব্রুয়ারি জাপান, চীন, ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতসহ ১৬ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রা ও সুযোগ-সুবিধা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে।
মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরে বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার খরচ বহন এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আরও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ নিজ ব্যবস্থাপনায় ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আবাসন তৈরি করেছে, আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। এই স্থানান্তর ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের একার পক্ষে এই ব্যয়বহন করা কষ্টসাধ্য। রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার ব্যয়বহনে সহায়তা করতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। ভাসানচরের তিন ভাগের একভাগ জায়গায় ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে এবং বাকী দুইভাগ জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করলে আরও রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা যাবে। ভাসানচরে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বন্ধুদেশগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। দ্রুততম সময়ে যত বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া যাবে ততই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে ২২ ফেব্রুয়ারি জাপান সরকার ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে ৪.৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে এবং ভাসানচরের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য মানবিক সেবা জোরদারের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার উন্নয়নে এই অর্থ কাজে লাগানো হবে। জাপান রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়নে ইউএনএইচসিআর-সহ অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখছে। এই সহায়তার ফলে কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের স্বনির্ভরতা অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি, উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান হবে ও ফলশ্রুতিতে মানবিক সহায়তার ওপর তাদের নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাবে।
ভাসানচরে জাপানের এই সহায়তা ইউএনএইচসিআরকে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও জীবিকার সংস্থান বিষয়ক কার্যক্রম সম্প্রসারণে সাহায্য করবে। এই অনুদানের মাধ্যমে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে আরও বেশি রোহিঙ্গা শিক্ষক ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি পাট উৎপাদন কেন্দ্রে পেশাগত ও অন্যান্য দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হবে। এই আর্থিক সহায়তার সাহায্যে ভাসানচরে দুটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং সরকারের ২০ শয্যার হাসপাতালের পাশাপাশি চিকিৎসাকর্মীদের আবাসনের সংস্কার করা হবে। জাপান সরকার ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা ও এনজিওগুলোকে ২০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলারের নতুন মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য এই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই সহায়তা সহ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের দেওয়া মার্কিন সহায়তার মোট পরিমাণ হলো ২১০ কোটি ডলার।
সম্প্রতি মিয়ানমার পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। চীন এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে বলে জানা যায়। এর অংশ হিসেবে ৮ মার্চ মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও আসিয়ানের কয়েকটি দেশসহ আট দেশের কূটনীতিকদের রাখাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ দেশের ১১ কূটনীতিককে মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে শহরে অন্তর্র্বতীকালীন ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা দেখানো হয়েছে। মিয়ানমার দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় বলে তাদের জানানো হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের দেওয়া এই তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছিল মিয়ানমার। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ওই তালিকা থেকে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মতি দেয়। অবশিষ্ট ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি থাকায় তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ১৫ মার্চ মিয়ানমারের থেকে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। প্রতিনিধি দলটি সাত দিনে ৪২৯ রোহিঙ্গার সাক্ষাতের মাধ্যমে তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য ৭৫০টি প্লটের ওপর ১৫টি নতুন গ্রাম তৈরি করতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২৩ মার্চ মিয়ানমার জানিয়েছে যে, এই পাইলট প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তাদের নিজ গ্রামে ফিরতে ইচ্ছুক। নিজ গ্রামে ফেরত না যেতে পারলে তারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। নাগরিক অধিকার, ভ্রমণ স্বাধীনতা কিংবা অন্যান্য জাতিসত্তার সমান অধিকারের নিশ্চয়তা পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে।
এই পাইলট প্রকল্পে মিয়ানমার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সাথে রাখেনি। গত ছয় বছর ধরে এই সংস্থাগুলোই রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে। জাতিসংঘ রাখাইনের পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের সহায়ক নয় বলে জানিয়েছে। ত্রাণ সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গারা আবার মানবিক বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই উদ্যোগে তাই তাদের সাথে রাখার দরকার ছিল বলে অনেকে মনে করে। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে আসছে যে, নাগরিকত্ব না পেলে তাঁরা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। রোহিঙ্গা অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে যে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া প্রত্যাবাসন হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি হবে। বাংলাদেশ সরকার টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়ে তা চলমান রাখার ব্যাপারে আগ্রহী, এ বিষয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সক্রিয় সহযোগিতা আশা করে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ প্রত্যাবাসন উপযোগী কি না তা দেখার জন্য ২০ জন রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ৫ মে সেখানে যায়। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মংডু শহরের আশপাশের ১৫টি গ্রাম, পুনর্বাসনকেন্দ্র, ট্রানজিট কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো দেখানো হয়েছে। তাদের সাথে যাওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সেখানকার পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে। রোহিঙ্গাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে তাদের সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখাতে এই সফরের ব্যবস্থা করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক চললে সহসাই ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় চীন ও মিয়ানমার। এ বছর আরও ৫ ধাপে প্রতিবারে ১ হাজার ২০০ জন করে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের মধ্যে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পাইলট প্রকল্প নির্বিঘেœ বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যাবাসন ও অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে আসিয়ান, ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবে বলে জানা যায়। পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২৫ মে কক্সবাজারের আসে। বৈঠকে প্রত্যাবাসনের পক্ষে নানা যুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরে তারা। ২৮০টি রোহিঙ্গা পরিবারপ্রধানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের যে ১৫টি গ্রামে পুনর্বাসনের প্রকল্প এবং সেখানে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকবে সে সম্পর্কে অবহিত করা হয়। রোহিঙ্গারা রাখাইনে পৌঁছার পর তাদের প্রথমে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট) দেওয়া হবে। পরে নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হবে। তখন স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ চাকরির সুযোগ-সুবিধা পাবে রোহিঙ্গারা। বর্তমান প্রত্যাবাসন উদ্যোগ ও সম্ভাব্য ছয় হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হলে বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ডিসেম্বর মাসে আরেকটা বৈঠক হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি বুঝতে হলে রোহিঙ্গাদের এই প্রত্যাবাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো প্রয়োজন। নচেৎ এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে, যা কারো কাম্য নয়। মিয়ানমারে গিয়ে তাদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অনির্দিষ্টকাল বাংলাদেশে থেকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারের সুযোগ-সুবিধা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা কতটা বাস্তব সম্মত তা বিবেচনা করতে হবে। কারণ, গত ছয় বছরে সেটা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মংডুতে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সচেতন করা গেলে প্রত্যাবাসনে তাদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গাদের এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। এই প্রেক্ষিতে দাতাগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা স্বার্থরক্ষায় কর্মরত সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ চলমান এই দীর্ঘ মেয়াদী মানবিক সংকট উত্তরণে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে পরিবার ভিত্তিক এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে আত্মবিশ্বাস যোগাবে এবং একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এই চলমান উদ্যোগে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে সাথে নেয়া না হলেও জাপানের সাথে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় জাপান প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত এই মানবিক উদ্যোগে পশ্চিমা বিশ্বের মুখপাত্র হিসেবে সমন্বয়কের কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার পর প্রথম দলের মিয়ানমারে অবস্থানকালীন কী কী সমস্যা হচ্ছে সেটা জেনে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইনের জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের সুসম্পর্ক স্থাপন ও সহবস্থান নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে কাজ করতে হবে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার, রাখাইনের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর রোহিঙ্গাদের প্রতি যে কট্টর মনোভাব ও বিরূপ ধারণা ছিল গত ছয় বছরে তা কিছুটা হলেও ইতিবাচক হয়েছে, যা আরাকান আর্মি ও এনইউজি’র বক্তব্য থেকে জানা যায়। রাতারাতি এই মনোভাব পরিবর্তন সম্ভব না, তবে ইতিবাচক দিকে তা চলমান থাকলে একদিন তা বদলে যাবেই।
ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ চলমান রাখবে বলে জানিয়েছে, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে রখাইনের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। রাখাইনের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেখানে কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ ফিরে আসলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান বৈরী মনোভাব কমে যাবে। এই পরিবেশ দ্রুত সৃষ্টি করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা জরুরি। জাতিসংঘ এবং এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর উচ্চ পর্যায়ে এই সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ প্রান্তে সীমিত না রেখে মিয়ানমারকে সাথে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় সে ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ ও কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল, এই দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সংকটের মোকাবেলায় একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরি ভিত্তিতে আপতকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাইলট প্রকল্পটি যেভাবে শুরু হয়েছে সেই পথ অনুসরণ করে এই প্রক্রিয়া যেন সফলতার মুখ দেখে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারে তার জন্য সকল পক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বৈশ্বিক এই সংকট বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলা করা হোক এবং বাংলাদেশকে এই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য চীন, মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক সমর্থন প্রয়োজন।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।