‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।’ (সূরা হুজরাত-১৩)
খান্দান, বংশ, গোত্র ও গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তা এগুলো অহঙ্কারের হোতা। পৃথিবীর সর্বপ্রথম যেই পাপিষ্ঠ গুনাহের খাতায় নাম লিখিয়েছিল সে হলো, শয়তান। প্রথম যে গুনাহের কারণে শয়তান আল্লাহর হুকুমকে মানতে অস্বীকার করেছিল সেটি হলো, বর্ণবাদী অহঙ্কার। তার অহঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল জন্মগত শ্রেষ্ঠত্বকে ভর করে। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম : আদমকে সিজদা করো। সবাই সিজদা করল। কেবল ইবলিশ করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সূরা আরাফে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে?’ সে জবাব দিলো- আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ এবং ওকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে।’ (আয়াত-১২) অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে কিনা আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং তার লানত নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
বংশগৌরব একটি বিরাট গোমরাহি, যেই গোমরাহি থেকে মানবজাতিকে সংশোধন করার জন্য উল্লিখিত আয়াতটি নাজিল হয়েছে। যে বিষয়টি আবহমানকাল ধরে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। সেই গোমরাহি হচ্ছে- বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণতা। প্রাচীন যুগ থেকে প্রত্যেক যুগে মানুষ সাধারণত মানবতাকে উপেক্ষা করে তাদের চার পাশে কিছু ছোট ছোট বৃত্ত টেনেছে। এ বৃত্তের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদের তারা আপনজন গণ্য করেছে আর বৃত্তের বাইরে জন্মগ্রহণকারীদের পর মনে করেছে। কোনো নৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে এ বৃত্ত আঁকা হয়নি; বরং নিজেদের অহঙ্কারী খেয়াল-খুশি ও জন্মের ওপর ভিত্তি করে এ বৃত্ত টানা হয়েছে। কোথাও এর ভিত্তি একই খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করা এবং কোথাও একই ভৌগোলিক এলাকায় কিংবা এক বিশেষ বর্ণ অথবা একটি বিশেষ ভাষাভাষী জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করা। তা ছাড়া এসব ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আপন ও পরের বিভেদ রেখা টানা হয়েছে।
এ মানদ-ে যাদেরকে আপন বলে মনে করেছে, পরদের তুলনায় তাদের কেবল অধিক ভালোবাসা বা সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এ বিভেদনীতি ঘৃণা, শত্রুতা, তাচ্ছিল্য ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতনের জঘন্যতম রূপ পরিগ্রহ করেছে। কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বাইরে গিয়ে এ ভেদনীতি সমাজ সভ্যতায় এমনভাবে ভিত্তিমূল গেড়েছে, যার প্রভাব থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। আলেম-ওলামা, জ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী ও যারা সমাজে সুশীল বলে পরিচিত, তাদের অনেকেই এই সঙ্কীর্ণ বৃত্তের বাইরে তাদের বিবেককে নিয়ে যেতে পারেননি। মুসলমানদের মধ্যেও ভেদাভেদ নীতি প্রচলিত রয়েছে। এ ধরনের বিভেদনীতি মারাত্মক ধ্বংসাত্মক গোমরাহি। এ গোমরাহির সংশোধনের জন্যই কুরআনের এ আয়াত নাজিল হয়েছে। আয়াতটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য বর্ণনা করা হয়েছে-
১. আমাদের সবার মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে আমাদের গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে আমাদের যত বংশধারা দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে তা একটিমাত্র বংশধারার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, যা একজন মা ও একজন বাপ থেকে শুরু হয়েছিল। এ সৃষ্টিধারার মধ্যে কোথাও এ বিভেদ এবং উচ্চ-নীচের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ আমরা এ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত আছি। একই আল্লাহ আমাদের স্র্রষ্টা। এমন নয় যে, বিভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। একই সৃষ্টি উপকরণ দ্বারা আমরা সৃষ্টি হয়েছি, এমন নয় যে, কিছুসংখ্যক মানুষকে কোনো পবিত্র বা মূল্যবান উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং অপর কিছু মানুষ অপবিত্র বা নিকৃষ্ট উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে। মূলত একই নিয়মে একই উপাদানে আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন নয় যে, আমাদের জন্মলাভের নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। তা ছাড়া আমরা একই পিতা-মাতার সন্তান। এমনও নয় যে, সৃষ্টির প্রথম দিককার মানব দম্পতির সংখ্যা ছিল অনেক এবং তাদের থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আলাদা আলাদা জন্মলাভ করেছে।
২. মূল উৎসের দিক দিয়ে এক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন জাতি গোত্রে বিভক্ত হওয়া ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ কথা স্পষ্ট যে, গোটা মানবসমাজের একটি মাত্র বংশধারা আদৌ হতে পারত না। বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন খান্দান ও বংশধারার সৃষ্টি হওয়া এবং তারপর খান্দানের সমন্বয়ে গোত্র ও জাতিগুলোর পত্তন হওয়া অপরিহার্য ছিল। অনুরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের পর বর্ণ, দেহাকৃতি, ভাষা ও জীবনযাপন রীতিও অবশ্যম্ভাবীরূপে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু প্রকৃতিগত এ পার্থক্য ও ভিন্নতার দাবি এ নয় যে, এর ভিত্তিতে উচ্চ ও নীচ, ইতর ও ভদ্র এবং শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট হওয়ার ভেদাভেদ সৃষ্টি হবে, একটি বংশধারা আরেকটি বংশধারার ওপর কৌলীন্যের দাবি করবে, এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের লোকদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করবে এবং তাদেরকে হেয় ও নীচ মনে করবে। যদি এমনটি করা হয় তবে অবশ্যই তা শয়তানের অনুসারী হিসেবেই করা হবে।
৩. মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ হলো তাকওয়া। মানুষের মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ যদি থেকে থাকে এবং হতে পারে তাহলে তা হচ্ছে নৈতিক মর্যাদা। জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান। কেননা তাদের মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের সবার সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও নিয়ম-পদ্ধতি এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতা-মাতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং মানুষ যেখানেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন সেটি দেখার বিষয় নয়; বরং যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে একজন অপরজনের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে এই যে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহভীরু, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকি ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট