পুঁজিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ইউরোপে ‘ব্লাক ডেথ’ নামে মধ্যযুগের সেই ভয়াবহ মহামারী থেকেই। ১৬ শতকের সেই মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছিল ইউরোপের ৬০ শতাংশ মানুষ। তখন থেকে ইউরোপের সমাজ, সংস্কৃতির সাথে অর্থনৈতিক কাঠামোও বদলে যায়। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের একটি ছোট্ট অংশ হঠাৎ পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। তারা দেশের বাইরেও নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করে। সামন্ত সমাজের পতন ঘটে আর ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণীর হাত ধরে আসে উপনিবেশবাদ, দাসত্ব আর সাম্রাজ্যবাদ।
১৮ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে শিল্পায়ন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। কৃষি, বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি ছেড়ে ধোঁয়া ওঠা চিমনি, কয়লার গাড়ি, গরম বাষ্প নিঃসরণ করা টেক্সটাইল মিল, বড় বড় রাসায়নিক কারখানা, এসবই হয়ে ওঠে শিল্পায়িত ইংল্যান্ডের চিত্র। ১৭৭৬ সালে পুঁজিবাদের জনক অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’ বই পুঁজিবাদকে বাস্তবে স্বীকৃতি দেয়। বাজারে ক্ল্যাসিক্যাল উদারবাদ শাখা-প্রশাখা মেলে, ধীরে ধীরে শুরু হয় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। পুঁজিপতিরা ব্যাপক পুঁজির মালিক হতে থাকে। তারা পুঁজি বিনিয়োগ করে শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত শ্রম থেকে অতিরিক্ত মুনাফা আয় করে এবং ধীরে ধীরে আরো ফুলেফেঁপে ওঠে।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক হয়। কারণ বাজারকে অবাধ স্বাধীনতা দিলে পুঁজিপতিরা সহজে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ করতে পারে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিন্তু বেশ কার্যকর হয় পুঁজিপতিদের জন্য।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রথম ভিত্তি ব্যক্তিগত মালিকানার সীমাহীন অধিকার; সাথে সব প্রকার উৎপাদন-উপায় এবং যন্ত্রপাতি ইচ্ছামতো ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং অর্জিত আয় ব্যবহার করতে পারে। যেকোনো স্থানে কারখানা স্থাপন এবং যতদূর ইচ্ছা মুনাফাও লুটতে পারে। শ্রমিক নিয়োগের যেমন সুযোগ রয়েছে, তাদেরকে শোষণ করে একচ্ছত্রভাবে মুনাফা লুণ্ঠনের পথেও কোনো বাধা নেই। ব্যক্তি বা গোটা সমাজ মিলিত হয়েও কাউকে কোনো প্রকার কাজ থেকে বিরত রাখার অধিকার কারো নেই।
পুঁজিবাদের প্রভাব ও পরিণতি
পুঁজিবাদের সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো- অসমতা, অস্থিতিশীলতা, একচেটিয়াত্ব, বেকারত্ব, পরিবেশ দূষণ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিনাশ। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো- অসমতা, অর্থাৎ ধনী আরো ধনী, আর গরিব আরো গরিব হয়। সম্পদের প্রবাহ এখানে একমুখী হয় এবং এ ব্যবস্থায় একজন পুঁজিপতি মৃত্যুকালে তার সম্পদ উত্তরাধিকারীদের সহজে দিয়ে যেতে পারে। ফলে শিক্ষাজীবনে একই শিক্ষায় সমরূপ শিক্ষিত হওয়া দু’জন মানুষ যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে, তখন প্রথম জনের হাতে তার পিতার রেখে যাওয়া কোটি টাকা পুঁজি থাকলেও দ্বিতীয়জন শুরু করে শূন্য থেকে। আর প্রতিযোগিতামূলক এবং সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এরকম অসমতা নিয়ে বাজারে টিকে থাকা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব। ফলে অনেকেই বাজার ত্যাগ করে এবং পণ্যের বাজারে একচেটিয়াত্ব কায়েম হয়। একচেটিয়া বাজার ক্রেতাদের অসহায় করে তোলে কারণ তারা বিক্রেতার দামে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য থাকে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকাংশেই অস্থিতিশীল কারণ তা শেয়ারবাজার, বন্ড, মুদ্রাবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অর্থবাজারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় যা যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বেকারত্ব বেড়ে যায়; সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মান কমে যায়। দেখা দেয় বিশ্বমন্দা, যেমন হয়েছিল ১৯৩০ সালে। এরপরও ছোটখাটো অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে বিশ্ব।
বেকারত্ব পুঁজিবাদের একটি প্রধানতম সমস্যা, কারণ এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উৎপাদনযন্ত্রের মালিককে অসীম মুনাফার অনুমতি দেয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগ নিয়ে পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফার লোভে শ্রমিক ছাঁটাই করে। অন্য দিকে পুঁজিপতিরা ভোগবাদী হয় এবং সমাজের যাবতীয় উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপান্তরিত হওয়ায় মুনাফাই এখানে প্রথম কথা। ফলে মুনাফা অর্জনের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উৎপাদন করা হচ্ছে যা প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস করছে, বাধাগ্রস্ত করছে টেকসই উন্নয়নকে।
পুঁজিবাদের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্র
পুঁজিবাদের সূতিকগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদ স্বল্পশিক্ষিতদের স্বার্থে কাজে লাগছে না; বরং ভালো চাকরি না পাওয়া এবং প্রকৃত মজুরি হ্রাস পাওয়ায় ওখানকার জীবন কঠিন হয়েছে। আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিয়েশাদি, গির্জা ও কমিউনিটির লোকজন সমাজে যারা দুঃখকষ্টে আছে তাদের সাহায্য করত। এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো আগেকার ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে; হারিয়েছে জীবনের অর্থও। আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অথচ সামন্তবাদের অবসানে পুঁজিবাদের যখন উত্থান হয় তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখাগুলো সমৃদ্ধ হয়েছিল; প্রতিযোগিতা বেড়েছিল; মানুষের দুর্দশা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। অনেক মানুষ অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। অনেক দেশ সম্পদশালী হয়ে উঠেছে; দ্রুততার সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে অর্থনীতির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারকে পরিহার করে তার জায়গায় ভিন্ন কিছু এসেছে; খাঁটি মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকেনি। জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থাকেনি।
রাজনৈতিক ক্ষমতা উত্তরোত্তর শ্রমজীবীদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সরকারের সম্মতি এবং যোগসাজশে ধনীরা অর্থনীতি দখল করে ফেলেছে; সম্পদ ও আয় বেড়ে বৈষম্য বেড়েছে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে।
দিনে দিনে পুঁজিবাদের ধ্বজাধারীরা দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা ভুলে যুদ্ধ বাধানো এবং করপোরেট মুনাফা অর্জনের পেছনে সময় দিচ্ছে। ফলে মানুষের মানবাধিকার নিয়ে চিন্তা করার সময় পায় না। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা খাতের ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের মধ্যে সে দেশের শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সেখানে মৃত্যুহার বাড়ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা ও নেশার কবলে পড়ে বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ সব কিছুর পেছনে পুঁজিবাদ বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার এই অস্থির ও নির্বান্ধব জীবনকে মেনে নিতে না পারায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। নব্য উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্রমাগত একা হয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন ছুটে যাচ্ছে। মানুষ ভোগবাদী জীবনের অস্থিরতার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিষণ্নতা থেকে আরোগ্যলাভের জন্য সেখানে ‘বিষমিশ্রিত’ বিশাল বিশাল ওষুধ কোম্পানি খোলা হচ্ছে।
মার্কিন পুঁজিবাদ শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নাগরিকদের পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধনের জন্য হুমকি নয়; বরং পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ভোগবাদী সমাজ সম্প্রসারণের কারণে পণ্যের অতি ব্যবহার, অপব্যবহার ও বিষক্রিয়া বাড়ছে। এটি গোটা পৃথিবীকে ধ্বংসের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদ যত বেশি বিকশিত হবে, অবস্থা তত খারাপ হতে থাকবে এবং ক্রমেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যেতে থাকবে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাদী অবয়ব
বাংলাদেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী কি না সে বিতর্ক এখন আর নেই; বরং দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ এখন খুবই দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়। তবে এ দেশের পুঁজিবাদের অভ্যুদয় ও বিকাশের সাথে অন্য দেশের পুঁজিবাদের পার্থক্য দেখা দেয়। দেশের সংবিধানে চার মূলনীতির একটি ছিল সমাজতন্ত্র। ফলে পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কর মওকুফ, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কর্মসূচিকে সমাজতান্ত্রিক নীতির বাস্তবায়ন বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে পুঁজির আদি গঠন শুরু সে সময়ই।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে সর্বক্ষেত্রে এবং গত দুই দশকে এর মাত্রা দ্রুততর হয়েছে। বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি বিশ্ব অর্থনীতির সাথে অঙ্গীভূত, বিশ্বায়িত ও বাজারিকৃত। পুঁজির আধিপত্য অর্থাৎ মুনাফা ও বাজারকে লক্ষ করে উৎপাদনসহ নানা অর্থনৈতিক তৎপরতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই ধারায় গত কয়েক দশকে জাতীয় আয় ও পরিষেবা খাত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। পাশাপাশি দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতার ক্ষরণ চলছেই। সম্পদের কেন্দ্রীভবন, দখল, লুণ্ঠন, চোরাই টাকার দাপট শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি সমাজকেও শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। নৈরাজ্য, সঙ্কট, সন্ত্রাস সব কিছুই বেড়েছে। ১৯৭৪ সালে সারা বাংলাদেশব্যাপী দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ; মারা যায় অনেক মানুষ। অথচ এ সময়েই লুটপাট, বিলাসী ভোগ, জাঁকজমক অনুষ্ঠান ও অপচয় ইত্যাদি শুরু হয়। সত্তরের দশক থেকেই বাংলাদেশ অর্থনীতির বাজারমুখী সংস্কারে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি দেশের পথপ্রদর্শক ও তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে আশির দশকে বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের যে ভিত্তি তৈরি হয়, তার ওপরই পরবর্তী দশকগুলোতে যাত্রাপথ তৈরি হয় এবং সাধ্যমতো সবাই তাতে যোগ হয়েছে।
বর্তমান শাসনকালে পুঁজিবাদের গতি অনেক দ্রুত হয়েছে। বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণী তৈরি ও বিকাশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অবৈধ পন্থায় ঋণ পাওয়া, ঋণ পরিশোধ না করা, সেই ঋণের ব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় দেয়ার নীতি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণের টাকা দিয়ে প্রাইভেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কার্যক্রম সুবিধাভোগীরা রাষ্ট্রের যোগসাজশেই করেছে, যা ব্যক্তির পুঁজির বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান, অদক্ষতা ইত্যাদিও বাড়তে থাকে। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণের মতাদর্শিক প্রচারও শক্তিশালী হয়। এসব সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফাভিত্তিক তৎপরতার সুযোগ বাড়িয়ে ব্যক্তিকে পুঁজিপতিতে রূপান্তর করা।
বাংলাদেশেও বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার ‘উন্নয়ন সহায়তা ও ‘কারিগরি সহায়তা’ নামের ঋণ ও অনুদান দিয়ে বিভিন্ন ঋণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হয়েছে আমলাতন্ত্র, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এসব প্রকল্পের কারণে দেশের জন্য ঋণের বোঝার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশের অর্থনীতির গতিমুখ নির্ধারণে নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। এসব প্রতিষ্ঠানের পতন ও এগুলোর সম্পদ বিতরণে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে।
দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয় আশির দশকেই এবং এ খাতে দ্রুত বিকাশের ফলে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণী সংগঠিত হয়, যা পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সোপান হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক নেতা, আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারা গার্মেন্ট মালিক বনে সংগঠিতভাবে শক্তিশালী শ্রেণী গঠন করেছে। শিল্প খাতে রফতানিমুখী তৈরী পোশাক খাতের বিকাশ ক্রমে শিল্প খাতের প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয় এবং পুরনো বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ধস নামে। এ খাতই বাংলাদেশে দ্রুত পুঁজি সঞ্চয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।
পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিকল্প, রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সমাধান এবং দারিদ্র্য বিমোচন-নারী ক্ষমতায়নের উপায় হিসেবে এনজিও রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। ক্রমে এনজিও জগতেও মেরুকরণ, পশ্চাৎপসরণ ও অঙ্গীভবন দেখা দেয়। এনজিও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাজার ব্যবস্থার বিকাশ প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সম্ভব হয়।
বিশ্বব্যাংক-এডিবির উদ্যোগে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গঠিত নীতির কাঠামোর পথ ধরে বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার কর্মসূচি শুরু হয়। এসব নীতিমালায় দেশীয় সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী, আমলা, কনসালট্যান্ট, সাব-কন্ট্রাক্টর গোষ্ঠী তৈরি হয়। জাতীয় বিপর্যয়ের বিনিময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য আকর্ষণ তৈরি করেছে উচ্চ মুনাফার এ খাত। পরিকল্পনা অনুযায়ী নব্বই দশক থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যক্তিমালিকানায় মুনাফাভিত্তিক তৎপরতা শুরু হয়। এর সুবিধাভোগীরা শিক্ষা ও চিকিৎসায় বাণিজ্যিক তৎপরতা বিস্তৃত করে এবং পুঁজিপতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
পুঁজি সঞ্চয়নের বিভিন্ন পর্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমর্থন বা অংশগ্রহণ বরাবরই ছিল নির্ধারক। মন্ত্রী, আমলাদের সহযোগিতা বা অংশীদারিত্বে এই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে নানাভাবে। আমলাতন্ত্র বস্তুত দেশী-বিদেশী করপোরেট গোষ্ঠীর সম্প্রসারণে সিদ্ধহস্ত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কনসালট্যান্ট যারা এসব কাজে বৈধতা দিতে নিজের বিশেষজ্ঞ পরিচয় বিক্রি করে। এরা ধ্বংসের প্রকল্পকে উপকারী প্রকল্প বলে ঘোষণা দেয়, এর বদলে নিজেরাও দ্রুত অর্থবিত্তের মালিক হয়।
পরিশেষে বলতে হয়, গত কয় দশকে শিল্প, কৃষি, নির্মাণ, যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সক্ষমতার বিকাশ ঘটেছে, তবে তা জনস্বার্থে তেমন কাজে আসেনি। ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, আটক বাণিজ্য সবই বর্ধনশীল, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের প্রক্রিয়া খুব শক্তিশালী। বিচার, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এখন প্রান্তিক অবস্থানে। এক দিকে প্রাণ, পরিবেশ বিপর্যস্ত, অন্য দিকে নজরদারি ব্যবস্থার বিস্তার লাভ করে। নগ্ন মুনাফা আগ্রাসন, নাগরিকদের ওপর ডিজিটাল নজরদারি সম্প্রসারণ, গোয়েন্দা সংস্থার খবরদারি, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার একচেটিয়াতন্ত্র, মিডিয়া-আদালত নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা সবই বর্তমান পুঁজিবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।
পুঁজি মুষ্টিমেয়ের হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে অথচ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে দুই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ঠিক একই সময়ে দেশের জিডিপি ও মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ধনিক গোষ্ঠীর সম্পদ প্রবৃদ্ধিতে বিশ্ব রেকর্ড, অর্থনীতিতে চোরাই টাকার অনুপাত বৃদ্ধি, বৈষম্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ দশা ও উন্নয়ন বা পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে উদ্বাস্তু সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি টেকসই কর্মসংস্থান হ্রাস, মাদক ও যৌন সাম্রাজ্যের বিস্তার, শিক্ষা ও চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ, বন ও নদী সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানার বিস্তার, সম্পদের অবিরাম পাচার, পাবলিক পরিবহনের দুরবস্থা ইত্যাদি বাংলাদেশের পুঁজিবাদের প্রবৃদ্ধির নমুনা। অর্থাৎ দেশের প্রায় সব সেক্টর পুঁজিপতিরা গিলে ফেলে মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্ত এবং গরিবদের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় পরবর্তী কোনো লেখায় লিখব ইনশা আল্লাহ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com