শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৩ অপরাহ্ন

মুঘল আমলের তাহাখানায় ঝুলছে তালা

মেহেদী হাসান শিয়াম :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০২৩

মধ্যযুগের ইসলাম প্রচারক শাহ সৈয়দ নেয়ামত উল্লাহ। তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গৌড়বঙ্গের উপকণ্ঠ বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের পিরোজপুর এলাকায় উপস্থিত হন। বিখ্যাত এই ইসলাম প্রচারকের আগমনী বার্তা শুনেই মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তাকে অভ্যর্থনা জানান। পরে তিনি ওই ইসলাম প্রচারকের সুবিধার্থে একটি মসজিদ আর বিশ্রামগার নির্মাণ করে দেন। সে সময়ই শাহ সুজা নিজের জন্য দাফেউল বালা নামে একটি বিশাল দিঘীর পাশে দুইতলা বিশিষ্ট একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ইট, পাথর-শুরকি দিয়ে নির্মিত দোতালা এই প্রাসাদটির নাম রাখা হয় তাহাখানা। সমসাময়ীক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক বিবরণ ইঙ্গিত করে যে এই তাহাখানার নির্মাতা বাংলার সুবাদার শাহ সুজা। ইতিহাসবিদ ও বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।তাহাখানা নামে এই দোতলা ইমারতটির ভগ্নাবশেষ মুঘল যুগের আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি বলে উল্লেখ করেছেন প্রতœতত্ত্ব বিভাগ। মানুষের মনে কৌতুহল জাগানো এই ইমারতটি গত দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শনার্থীরা বিশেষ এই ভবনটিতে ঢুকতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাহাখানা ভবনটিতে ইসলামিক যাদুঘর নির্মাণ করার জন্য ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে বলে দাবি প্রতœতত্ত্ব বিভাগের। তবে কবে নাগাদ যাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু হবে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী তাহাখানা অবস্থিত। গৌড়ের পিরোজপুর এলাকায় দাফেউল বালা নামে একটি দীঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত অবকাঠামোটি ঐতিহ্যগতভাবে তাহাখানা নামে পরিচিত। তাহাখানা ফার্সি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। এই ভবনটি দুইতলা বিশিষ্ট। এর একতলা ভূগর্ভে (মাটির নিচে) অন্য আরেক তলা মাটির উপরে। ভবনটি উত্তর দক্ষিণে ১৬৬ ফুট লম্বা এবং প্রায় ৩৮ ফুট চওড়া।
জানা যায়, মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা বাংলার সুবাদার থাকাকলে ১৬৩৯-১৬৫৮ খ্রি. মতান্তে ১৬৩৯-১৬৬০ খ্রি. তাপনিয়ন্ত্রিত হিসেবে তাহাখানা নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি আছে যে, শাহ সুজা তার মুর্শিদ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে শীতকালীন বাসের জন্য পিরোজপুরে তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে এ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে শাহ সুজাও এখানে এসে বাস করতেন। অস্থায়ী বসবাস করার জন্য এই ভবনটিকে স্থানীয়রা এখনও শাহ সুজার কাছারি বাড়ি নামেই চেনেন।
প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বলছে, শাহ নেয়ামতুল্লাহ ওয়ালীর মাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে শাহ সুজার নির্মাণ করা দোতলা ইমারতটির ভগ্নাবশেষ মুঘল যুগের আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ইটপাথর-শুরকি দিয়ে নির্মিত ইমারতটি তাহাখানা নামেই প্রসিদ্ধ। এখানে মোট ১৭টি কক্ষ আছে। গৌড়ের প্রাচীন কীর্তিগুলোর মধ্যে এ শ্রেণির ইমারত অন্য আরেকটি এমন ইমারতের দেখা পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে মুঘল আমলে নির্মিত এই তাহাখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের ফাটল ধরা জায়গাগুলোকে মেরামত করে নতুনহালে সংস্করণ করা হয়েছে। মূল ফটকের পাশাপাশি ভেতরের ঐতিহ্যবাহী তাহাখানার বারান্দাতেও ঝুলছে তালা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুরা তাহাখানায় ঢুকতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। প্রাচীন নির্দশন নিয়ে লেখা বিভন্ন বইগুলোতে লেখা আছে তাহাখানার কথা। বইয়ে পড়া তাহাখানার বর্ণনা পড়ে সরেজমিনে দেখতে এসেই পড়তে হয়েছে বাঁধার মুখে। কোনোভাবেই ভিতরে ঢোকা সম্ভব না হওয়ায় আশপাশের এলাকাগুলোতে অবস্থিত দর্শীয়স্থানগুলো দেখে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাদের।
তাহাখানার বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন রেজাউল করিম। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে প্রাচীন আমলের নির্দশনগুলো দেখতে এসেছেন। তাহাখানার ভিতরে না ঢুকতে পেরে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শখ করে ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখেছি। এই জেলার অন্যসব নিদর্শনগুলো দেখে নিয়েছি কিন্তু তাহাখানায় ঢুকতে পারিনি। কেমন জানি একটা অপূর্ণতা মনে হচ্ছে। কিছু করার নাই, না দেখেই বাড়ি ফিরতে হবে।’ দীর্ঘ দিন ধরে তাহাখানার সার্বিক অবস্থা দেখাভাল করেন প্রতœতত্ত্ব বিভাগের কর্মচারী এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘তহাখার দরজা অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। নতুন করে ভবনটিতে রংয়ের কাজও করা হয়েছে। শুনেছি এখানে যাদুঘর করা হবে তাই এখন আর খোলা হয় না।’ তার ভাষ্য মতে, তাহাখানা ভবনটিতে বানানো হবে ইসলামিক যাদুঘর। যাদুঘর নির্মাণ করার জন্য ঘরটিকে ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। ফলে এখন এই ভবনটিতে দর্শনার্থীরা ঢুকতে পারছেনা ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের আদেশেই। যাদুঘর নিমির্ত হলে ২০ টাকার টিকিট কেটে ভবনটির ভিতরে ঢুকতে হবে। সোনামসজিদে অবস্থিত প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অফিস সহকারী শাহনুজ্জামান বলেন, ‘কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে ভবনটির সংস্কার করা হয়েছে। তাহাখানা ভবনটি দীর্ঘ দুই বছর ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটিকে যাদুঘর বানানোর জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এই কারণে আপাতত তালা খোলা হয় না। তিনি আরও বলেন, ‘সোনামসজিদে প্রতœতত্ত্ব অফিসের পাশাপাশি তাহাখানা নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট লোকবল নাই। তাহাখানায় ১০-১২ জন জনবল দরকার হলেও আছে মাত্র ৪ জন। এছাড়াও এখানে আনসার সদস্যও নেই। এসব কারণে হয়তো ইসলামিক যাদুঘরটি সম্পর্ণ করতে বিলম্ব হচ্ছে।’ চলতি বছরের তোহাখানা ভবনটিতে ইসলামিক যাদুঘর চালু করার কথা শুনেছিলেন তিনি। কিন্তু কবে নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু হবে এখনও আভাস পাননি তিনি।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা. নাহিদ সুলতানার সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার হলেও, কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। রাজশাহী বিভাগে ১৪৮টি প্রতœতত্ত্ব স্থানের তালিকা করে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় রয়েছে মোট ১৮টি। এরমধ্যে তাহাখানা একটি।-।। রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com