৫৪ বছর বয়সী উদেনি কালুদান্ত্রি ছিলেন একজন বন্দর-কর্মী। কিন্তু গত বছর তিনিই রাতারাতি পরিণত হয়েছিলেন একজন ‘সেনসেশনে’। যদিও এর কারণ ছিল এমন কিছু- যার সাথে তার চাকরির কোনো সম্পর্কই ছিল না। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে পড়ার কয়েক দিন পর একটা ভিডিও প্রকাশ হয়, যা কালুদন্ত্রিকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্টের পতাকায় মোড়া একটি বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে আছেন উদেনি কালুদন্ত্রি। এর আগেই অবশ্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই সব ছবি, যাতে দেখা যায় যে প্রাসাদের ভেতরের সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যুবকরা। অথবা কেউ কেউ প্রেসিডেন্টের খাটের ওপর লাফাচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছিল কালুদন্ত্রির ভিডিওটিও। ওই সব ছবি-ভিডিওতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্শার অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার লাখ লাখ মানুষ কতটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। রাজাপাকশা এর পরপরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, আর পদত্যাগ করেন তার কয়েক দিন পর। দেশটির ওই নজিরবিহীন গণআন্দোলনের জন্য এ ঘটনা ছিল বিরাট বিজয়। কিন্তু তার এক বছর পর এখন শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম।
জনগণের সংগ্রাম: ওই সময়টায় অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতি ছিল আকাশছোঁয়া। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য হয়ে গিয়েছিল, দেখা দিয়েছিল জ্বালানি, খাদ্য আর ওষুধের সঙ্কট। কোনো কোনো দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছিল ১৩ ঘণ্টা ধরে।
শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর কখনো ওই দেশে এত গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়নি। অনেকের চোখেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকশা ও তার পরিবারই ছিল ওই সঙ্কটের জন্য দায়ী। তার ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতির কারণে দেখা দিয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট। আবার রাজাপাকশা পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, দুর্নীতি ও সরকার অর্থ তসরুপের। কিন্তু রাজাপাকশা ও তার পরিবার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তাদের মতে, সংকটের আসল কারণ ছিল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশটির পর্যটন খাত থেকে আসা রাজস্ব আয়ে ধস নামা এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে জ্বালানির দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া।
ওই সময় রাজধানীর জনপ্রিয় সৈকত তীরবর্তী উন্মুক্ত স্থান গল ফেস গ্রিনে তখন বিপুল জনতার সমাগম হয়েছিল। বিক্ষোভ চলছিল দিন-রাত ধরে। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে জনসমাগম বেড়ে যেত। সেখানে সমবেত হতো পরিবার, শিক্ষার্থী, পুরোহিত, নান, মাওলানা ও ভিক্ষুসহ নানান ধর্মগুরুরা। তাদের স্লোগান একটিই, ‘গোতা গো হোম’। ওই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশেই। প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার তিনটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় সিনহালা, তামিল ও মুসলিমদের তৈরি হয়েছিল ঐক্য।
কয়েক সপ্তাহ পরে ওই বিক্ষোভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল নজিরবিহীন সব ঘটনার। রাজাপাকশাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে পড়েছিল প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। ওই দলে ছিলেন উদেনি কালুদন্ত্রিও। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকশা ওই সময় তার প্রাসাদে ছিলেন না। ফলে বিক্ষোভকারীরা যা ইচ্ছে তাই করতে পেরেছিল। তারা বিছানার চাদর থেকে শুরু করে বই পর্যন্ত সব কিছুই যে যেভাবে পারে নিয়ে যায় স্যুভেনির বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। কালুদন্ত্রি বলেন, ‘আমি নিয়ে গিয়েছিলাম প্রেসিডেন্টের পতাকাটি, কারণ আমার মনে হয়েছিল এসব প্রতীক চিহ্নগুলো ছাড়া রাজাপাকশা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কাজ চালাতে পারবেন না।’ শ্রীলঙ্কার রীতিনীতি অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের পতাকাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারণ যখনই একজন নতুন প্রেসিডেন্ট আসেন, তখনই প্রেসিডেন্সিয়াল পতাকার ডিজাইন বদল করা হয়। পাঁচ দিন পর রাজাপাকশা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং সিঙ্গাপুর থেকে তার পদত্যাগের কথা জানান। একেই দেখা হয় শ্রীলঙ্কার জনগণের সংগ্রাম বা আরাগালায়ার বিজয় হিসেবে।
শ্রীলঙ্কায় মাত্র কয়েক মাস আগেও রাজাপাকশা পরিবারের ওই পতনের কথা কেউ ভাবতেও পারত না।
রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ওই পরিবার সেখানে জনপ্রিয় ছিল। এর একটা বড় কারণ ২০০৯ সালে তামিল টাইগার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চূড়ান্তভাবে দমন এবং ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান।
কিন্তু ওই বিক্ষোভের পর এক বছর পার হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সমস্যায় পড়েছে বিক্ষোভকারীরাই। রাজাপাকশা পরিবার ও অন্য আরো বেশি কিছু রাজনীতিবিদ- যারা ওই সময় জনরোষের শিকার হয়েছিলেন তারা ফিরে এসেছেন দেশে। শুধু তাই নয়, ফিরেছেন ক্ষমতাধর অবস্থানেও।
কী করে এমনটা ঘটেছে? রাজাপাকশা দেশ ছেড়ে পালানোর পর পার্লামেন্টের এক ভোটের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট হন রানিল বিক্রমাসিংহে। তিনি একজন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ। রাজাপাকশার দল পার্লামেন্টে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। তবে তারাও বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন দেয়।
তিনি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গল ফেস থেকে জনতাকে সরিয়ে দিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেখানে হাজির হয় বহু সৈন্য। তারা বিক্ষোভকারীদের তাবুগুলো ভেঙে দেয়।
কালুদান্ত্রি নিজেও পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং প্রেসিডেন্সিয়াল পতাকার অবমাননার দায়ে ২১ দিন জেল খাটেন। তার বিরুদ্ধে করা ওই মামলা এখনো চলছে। তিনি তার চাকরি থেকেও দু’মাসের জন্য সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘এর জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি সেটা করেছিলাম আমার দেশ ও জনগণের জন্য।’ তার একমাত্র দুঃখ, এই যে তারা গোতাবায়া রাজাপাকশাকে পদত্যাগ করাতে পেরেছিলেন, কিন্তু দেশে একটা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাজাপাকশার বিদায়ের পর নতুন সরকার জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট কাটাতে কিছু পদক্ষেপ নেয়। অনেক বিক্ষোভকারীই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু তারপরো সবচেয়ে কঠোর অঙ্গীকারবদ্ধ কিছু বিক্ষোভকারী কিন্তু রাজপথ ছাড়েনি। তাদেরকে বিক্ষোভস্থলগুলো থেকে সরিয়ে দিতে কর্তৃপক্ষ শক্তি প্রয়োগ করে, ব্যবহার করে তাদের সব রকম আইনি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার।
সাবেক প্রেসিডেন্ট এখন বাস করছেন একটি উচ্চশ্রেণির সরকারি বাংলোতে। তার মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যই সরকারের পদে পুনর্বহাল হয়েছেন।
যাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে: রাষ্ট্রশক্তির চাপ পুরোপুরি যাদের গায়ে লেগেছে তাদের একজন হলেন ওয়াসান্থা মুদালিগে। তিনি একজন বামপন্থী কর্মী এবং অন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক আহ্বায়ক। বিক্ষোভের সময় তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান ভূমিকায়।
তাকে পরে গ্রেফতার করা হয় সন্ত্রাস দমন আইনে। মুদালিগে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আদালত না থাকলে আমাকে আরো বেশি দিন জেলে থাকতে হতো।’ কলম্বোর একটি আদালত মুদালিগের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ খারিজ করে তাকে মুক্তির আদেশ দেয় ফেব্রুয়ারি মাসে। বিচারক বলেছিলেন, কর্তৃপক্ষ আইনটির অপব্যবহার করেছে। এমন আরো অনেক বিক্ষোভকারীকেই বিভিন্ন আইনে অভিযুক্ত করা হয়। কয়েকজনকে কারাদ- দেয়া হয়। তবে বিক্ষোভের নেতাদের অনেকেই তাদের কাজের জন্য গর্বিত। সোয়াস্তিকা আরুলিঙ্গম একজন মানবাধিকার আইনজীবী ও অধিকারকর্মী। তিনি বলেন, এ বিক্ষোভ ঐতিহাসিক ও সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করলেও এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়নি।
তার কথায়, ‘রাজনৈতিক পদ্ধতি, জবাবদিহিতা, দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। যারা জনগণের সম্পদ চুরির জন্য দায়ী, তারা এখনো ক্ষমতায় আছে।’ বিক্ষোভ এখন শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সমাধি ব্রহ্মনায়কের মতো কিছু বিক্ষোভকারী বলেন, এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণের শক্তি কী করতে পারে।
ব্রহ্মনায়কে বলেন, ‘ওই বিক্ষোভ আমাদের আশা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, আমরা উপলব্ধি করেছি যে আমরা যৌথভাবে কী অর্জন করতে পারি। বেশ কিছু তরুণ এখন রাজনীতিবিদ হতে চায়। আমাদের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে।’ বিক্রমাসিংহের সরকার মার্চ মাসে আইএমএফের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলারের অর্থায়ন পেয়েছে। এর ফলে কলম্বোর পক্ষে জ্বালানি, খাদ্য ও রান্নার গ্যাস সরবরাহ করার জন্য অর্থসংস্থান হয়েছে, অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করতে অন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
বিদেশে থাকা শ্রীলঙ্কান শ্রমিকদের কাছে থেকে আসা রেমিট্যান্স ও পর্যটন খাতের আয় এখন বাড়তে শুরু করেছে। দেশটি আবার উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। যদিও এখনো আরো বহুদূর যেতে হবে। দেশী ও বিদেশী মিলে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় আট হাজার কোটি ডলার। এই ঋণ পরিশোধ করাটা হবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। কলম্বো এখন সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এই ঋণ পুনঃতফসিল করার একটি কাঠামো নিয়ে দাতাদের সাথে আলোচনা করছে। তবে সরকারের কিছু আর্থিক প্রস্তাব নিয়ে বিরোধীদলসহ অনেক শ্রীলঙ্কানের উদ্বেগ রয়েছে।
আরুলিঙ্গম বলেন, ‘দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট এখনো চলছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে এখন মানুষের অবসর জীবনের জন্য যে সঞ্চয় রেখেছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ যোগ হচ্ছে। অবস্থার কোনো উন্নতি না হলে লোকে আবার রাস্তায় নেমে আসতে পারে।’ সূত্র : বিবিসি